নিজস্ব সংবাদদাতা : শুভজিৎ, আরিফ, অমিতের মতো খুদে পড়ুয়াদের হাতে বছর সাতাশের এক যুবক তুলে দিচ্ছেন খাতা, পেন, লজেন্স, বিস্কুট। আবার তাঁর সুরে অভীক, ঋতম, শুভম, ঋজুর মতো শিশুরা গলামিলিয়ে বলে উঠছে ‘আ-এ আমটি খাবো পেড়ে’ কিমবা ‘কুমোর পাড়ার গরুর গাড়ি’। এভাবেই দীর্ঘ সাড়ে পাঁচ বছর সম্পূর্ণ বিনা পারিশ্রমিকে পড়ুয়াদের শিক্ষাদান করছেন আমতার সোনামুই গ্রামের মিন্টু মাজি। আমতা-১ ব্লকের সোনামুই গ্রামের অন্যতম প্রাচীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সোনামুই উচ্চ সংলগ্ন প্রাথমিক বিদ্যালয়। সালটা ২০১৫। মিন্টুবাবু তখন স্নাতক স্তরের ছাত্র। তাঁর দাদু কাশীনাথ মাজি বিদ্যালয় থেকে অবসর নেওয়ায় তাঁর প্রাণপ্রিয় বিদ্যালয়ে শিক্ষক সংখ্যা একদম তলানিতে ঠেকেছে। যার জেরে পড়াশোনা কার্যত বন্ধের মুখে। ঠিক সেই মুহুর্তে কালবিলম্ব না করে নির্দ্বিধায় স্বেচ্ছায় এগিয়ে আসেন বিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্রটি।
সেই শুরু যা আজও প্রবহমান। বিনা পারিশ্রমিকে দীর্ঘদিন ধরে পাঠদান করে চলেছেন মিন্টুবাবু। পাঠদানের পাশাপাশি বিদ্যালয়ের অন্যান্য শিক্ষকদের সাথে পড়ুয়াদের শেখান আবৃত্তি ও অঙ্কন। বিদ্যালয় সূত্রে খবর, মিন্টুবাবু কোনো পারিশ্রমিক তো নেনই না, উপরন্তু মাঝেমধ্যেই পড়ুয়াদের বিস্কুট, লজেন্স, কেক খাওয়ান। কিনে দেন পেন, খাতা, রং পেন্সিল। সোনামুই গ্রামের বাসিন্দা মিন্টু খুব ছোটো বেলায় মা-বাবা’কে হারান। অভাবের সংসারে দাদুর কাছেই মানুষ হয়েছেন। ইচ্ছে থাকলেও অর্থাভাবে উচ্চশিক্ষার জন্য পা বাড়াতে পারেননি। মিন্টু মাজির কথায়, “দাদু ছিলেন বিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষক, সর্বোপরি তিনি নিজে ছিলেন এই প্রতিষ্ঠানের প্রাক্তন ছাত্র। তাই এই বিদ্যালয়ের সাথে আমার সম্পর্কটা অত্যন্ত নিবিড়।” তাই তিনি শিক্ষক অভাবের কথা জানার সাথে সাথেই বিদ্যালয়ে পাঠদানের কাজ শুরু করেন।
তিনি আরও বলেন, শিক্ষাদানে আরও শিক্ষালাভ করা যায় এবং পড়ুয়াদের মাঝে খুঁজে পাওয়া যায় অপার আনন্দ। পাঠদানের পাশাপাশি বিদ্যালয়ের বর্তমান দুই শিক্ষক দুর্বাদল ও নবকুমারের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ছাত্রদের নিয়ে স্থানীয় মানুষের বাড়ি গিয়ে তথ্য অনুসন্ধানের কাজ করে প্লাস্টিক ও পানীয় জল অপচয় সম্পর্কে সচেতনতার শুভ বীজ বপন করা থেকে শুরু করে বৃক্ষরোপণ বা তার পরিচর্যা সবক্ষেত্রেই হাতে হাত মিলিয়ে লড়াই চালান। মিন্টু মাজি বিনা পারিশ্রমিকে বিদ্যালয়ে পাঠদানের পাশাপাশি বাড়িতে বেশ কয়েকজন দুঃস্থ পড়ুয়াকে বিনা বেতনে পড়ান। এছাড়াও তিনি খড়দহ গ্রাম পঞ্চায়েতের চুক্তিভিত্তিক কর্মী হিসাবে ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া সম্পর্কে স্থানীয় মানুষের কাছে সচেতনতার বার্তা পৌঁছে দেন।
বর্তমানে করোনা পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে বিভিন্ন জায়গায় পঞ্চায়েতের তরফে স্যানিটাইজেশনের কাজ চালাচ্ছে স্বভাবে লাজুক এই যুবক। মিন্টুবাবুর আয় বলতে এই কাজের জন্য পাওয়া মাসিক ৮০০-১০০০ টাকা। তা নিয়ে অবশ্য ভাবেন না তিনি। হাসিমুখে বলে ওঠেন, “এভাবেই আমার চলে যায়”। বিদ্যালয়ের বর্তমান ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক দুর্বাদল ভৌমিক মিন্টু বাবুর ভূয়সী প্রশংসা করে জানান, “তাঁর মতো মানুষ বর্তমান সমাজ বিশেষত যুবদের কাছে প্রেরণা।” তিনি অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে একজন ‘শিক্ষক’ রূপে দায়িত্ব পালন করেন বলে দুর্বাদল ভৌমিক জানান। পড়ুয়াদের অভিভাবক-অভিভাবিকারাও তাঁর প্রশংসা করে জানান, “তিনজন শিক্ষক না হলে বিদ্যালয়ে পাঁচটা ক্লাস চালানো অত্যন্ত কঠিন ব্যাপার।” আত্মকেন্দ্রীক জীবনের বাইরে এসে মিন্টুবাবুর মতো অগণিত মানুষের হাত ধরে সেবাব্রত ও শুভব্রতের পূত পবিত্র দীপ্ত আলোকে আলোকিত হোক সমগ্র সমাজ এই আশাই যেন ঝরে পড়ে তাদের গলা থেকে। পার হয়ে যায় এক একটি শিক্ষক দিবস, কিন্তু অন্ধকারেই থেকে যান মিন্টু মাজির কত নিষ্ঠাবান ও সেবাপরায়ণ ‘শিক্ষক’।