– সুকুমার দেবনাথ
আশার কথা – ভিন রাজ্যের শ্রমিকরা (পরিযায়ী) যখন দেশে ফিরবেন তাদের জন্য দুমাসের ফ্রী রেশন, একশ দিনের কাজ, মজুরী বৃদ্ধির পরিকল্পনা ঘোষণা করেছেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী।
হতাশার কথা – * আসানসোলে ট্রেন দাঁড়িয়ে আছে এক মহিলা বলছেন তিনদিন ভাত খাইনি। * কাটোয়ায় ট্রেন এসে দাঁড়ালে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের পক্ষ থেকে খাবারের প্যাকেট দিতে গেলে ক্ষুধার্ত শ্রমিকদের মধ্যে মারপিট খাবার নিতে কাড়াকাড়ি । * বিহারে চার শ্রমিকের দুর্ঘটনায় মৃত্যু । * উত্তর প্রদেশে পথ দুর্ঘটনায় চৌদ্দ শ্রমিকের মৃত্যু। * মহারাষ্ট্রের ঔরঙ্গাবাদে ট্রেন দুর্ঘটনায় (রেললাইনে কাটা পড়ে) ষোল জন ঘুমন্ত শ্রমিকের মর্মান্তিক মৃত্যু। বীভৎস মর্মান্তরিক সব ঘটনা ঘটে চলেছে ভিন রাজ্যের শ্রমিকদের। তারসঙ্গে বাংলার শ্রমিকদের অবস্থা আরো বেশি খারাপ। কেননা এখানে শ্রমিকদের ফিরিয়ে আনা নিয়ে গড়িমসি করার অভিযোগ।
‘দিদি আমরা সতরেশ (1700)কিলোমিটার হেঁটে আসছি। তুমি রেডি থেকো। ভোট তোমাকেই দেব। সুস্থ থেকো।’ ব্যাঙ্গাত্মক ভিডিওটি বছর কুড়ি বাইশের এক তরুণ পোস্ট করেছে। আরেক শ্রমিকের ভিডিও বার্তা –
‘মমতা খালা (মাসি) আমাদের ঘরে ফেরার ব্যাবস্থা করলেন না। 2021দেখে নেব।’ তেলেঙ্গনায় আটকে পড়া কাকদ্বীপের একদল মৎস্যজীবীর ভিডিও – ‘রাজ্যে কাজ নেই তাই ভিন রাজ্যে এসেছি। আমাদের নিতে দিদি নাকি রাজী নন। আমরা না খেয়ে আছি। খাবার নেই কী করে বাঁচব। আমরা 40 লাখ বাইরে পড়ে আছি। আমাদের জন্য কিছু করছে না আমাদের রাজ্য’।
ভিডিওগুলো দেখলাম হোয়াটসঅ্যাপে। বক্তব্য কমবেশি এক। টার্গেটও এক। রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভ । ভিডিওগুলি সঠিক কিনা সেই টেকনোলজি আমাদের নেই। তাই এর সত্যতা যাচাই করা সম্ভব হয়নি। তবে এদের মনোভাব রাজ্য সরকার বিরোধী। রাজ্যের ভূমিকায় সন্তুষ্ট নয়। সোশ্যাল মিডিয়ায় উগরে দিচ্ছে বিষ।
রক্তাক্ত পা, সদ্যোজাত সন্তান কোলে হেটেই চলেছেন অসহায় মা, নি:স্ব, বেবশ, বিপর্যস্ত লক্ষ লক্ষ মানুষদের নিয়ে ঘৃণ্য জঘন্যতম রাজনৈতিক খেলা চলছে সারাদেশজুড়ে। উদ্দেশ্য গরীব মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলা। শ্রমিরা এতটা অবহেলিত স্ব স্ব রাজ্যের কাছে এই অভিমান তাদের কুরেকুরে খাচ্ছে। তেমনটি মনে হবে এদের সঙ্গে কথা বললে।
শ্রমিক যারা এখন পরিযায়ী তারা তো আমাদেরই লোক। আমাদের প্রতিবেশী। তারা কাজের খোঁজে পররাজ্যে। আজ তারা চরমতম সমস্যার সন্মুখীন। তাদের স্বরাজ্যে ফেরানো নিয়ে চলছে তর্ক বিতর্ক। এই বিতর্কের সূত্রপাত করেছে লকডাউনের ঘোষনা। শ্রমিকরা কোন সময় পাননি ঘরে ফেরার। যারফলে ভিন রাজ্যে কাজ করতে যাওয়া মানুষের আজ চরম দুর্গতি।
এহো বাহ্য। রাজ্যগুলিও চরম সমস্যায়। তাদের ঘরের মানুষদের ঘরে ফেরাতে চাইছে না। এসব অভিযোগের যন্ত্রণা বইতে হচ্ছে। সবার ওপর করোনা, COVID-19, কোরেন্টেন এসব নিয়ে এমন একটি হাড়হিম করা পরিবেশ তৈরী হয়ে যায়, যার ফলে কোন রাজ্য সরকারের পক্ষে কোন পরিকল্পনা করা সম্ভব ছিল না। আর শ্রমিকরাও করোনার ভীতিতে খুব একটা উচ্চবাচ্চা করেন নি। চরম দুর্দশার মধ্যেও নিজেদের সংযত রেখেছেন। কষ্ট স্বীকার করেছেন। অপেক্ষা করেছেন যে এই তিন সপ্তাহ লকডাউনের পর সব দুর্যোগ কেটে যাবার। মুখবুজে দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করেছেন সব দু:খকষ্ট।
কিন্তু সমস্যা কমল না। আবার লকডাউনের দিন বাড়ল। এবার ধৈর্যের বাঁধ ভাঙল। প্রথম ধাক্কায় শ্রমিকদের পুঁজি ফাঁকা। কপর্দকশূন্য কেউকেউ। এরফলে ঘরে ফেরার তাড়া বাড়ল। চারিদিক থেকে রাজ্য সরকারগুলির ওপর চাপ বাড়তে থাকল। রাজ্য সরকার গুলি কেন্দ্রীয় সরকারের ওপর পাল্টা চাপ দিলেও লকডাউন ভাঙার ঝুঁকি কোন সরকার নিতে চায়নি। যত দিন যেতে লাগল তত শ্রমিকদের রাগ জমতে লাগল তাদের রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে। তাই ওপরের ভিডিও গুলো দেখলে বোঝা যায় তাদের ক্ষোভ তাদের রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে। ক্ষোভ দিদির বিরুদ্ধে। তাদের অভিমান অভিযোগ দিদির বিরুদ্ধে। দিদি আমাদের ঘরে ফেরায়নি!
এবার রেল দপ্তর থেকে খবর লিক হল যে রাজ্য সহযোগীতা করছেনা। ট্রেন চাইছে না। ট্রেন ঢুকতে দিচ্ছে না। যেগুলো শ্রমিকদের নিয়ে ফিরে এসে রাজ্যে ঢোকার মুখে সেগুলো সীমান্তে দাঁড়িয়ে। এসব কথা রেল ফাঁস করে দেয়। লোকসভার বিরোধী দলনেতা কংগ্রেস সাংসদ অধীর চৌধুরী তাতে ইন্ধন যুগিয়েছেন। এটাও প্রচার হল যে রাজ্যসরকার ভাবতে শুরু করেছে এই লোকেদের রাজ্যে ফেরালে আবার আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে যেতে পারে। লোকের মধ্যে বিপরীত প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে।
আর যত দেরি হচ্ছে তত ধৈর্যের বাঁধ ভাঙ্গছে অসহায় নিরন্ন ঘরে ফিরতে চাওয়া গরীব মানুষেদের। কেন্দ্রীয় সরকার বনাম রাজ্য সরকারের তর্জায় তাদের তেমন আগ্রহ নেই। যেকোনো মুল্যে তারা বাংলায় ফিরতে চান। পরিবারের সঙ্গে যুক্ত হতে চান।
প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘শ্রমিকদের ঘরে ফিরতে চাওয়াটা স্বাভাবিক প্রবৃত্তি ‘।
এটা শুধু যে একা পশ্চিমবঙ্গের সমস্যা তা নয়। বিজেপি, অ-বিজেপি রাজ্যসরকারগুলির বিরুদ্ধে স্ব স্ব রাজ্যের শ্রমিকদের ক্ষোভ আছে। তবে পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে একটু বেশি। পশ্চিমবঙ্গে মাত্র 11মাস পরেই ভোট। শ্রমিকরা তাই আরো বেশী সোচ্চার হচ্ছেন। প্রকাশ করছেন ক্ষোভের কথা।
কম করেও দুই লাখের বেশি শ্রমিক গুজরাট, মহারাষ্ট্র, দিল্লী, ঊত্তর প্রদেশে রয়েছেন যারা পশ্চিমবঙ্গ থেকে গিয়েছেন। আরোষকয়েক লক্ষ আছেন তেলেঙ্গনা, অন্ধ্র, কর্ণাটক, কেরলে।মোট সংখ্যা তিরিশ (30)থেকে চল্লিশ (40) লক্ষ হবে।
এই পরিবারগুলির কাছে এমন একটি প্রচার আছে যে মমতা সরকার শ্রমিকদের রাজ্যে ফেরাতে চাইছেন না। একারণে শ্রমিক ও তাদের পরিবার এই সরকারের বিরুদ্ধে রুষ্ট। তা তাদের ভার্চুয়াল মিডিয়ার প্রচার থেকে তা বেশ স্পস্ট ফুটে উঠছে।
শাসক দল তৃণমূল পাল্টা অভিযোগ আনছে যে তারা ট্রেন চেয়েও পাচ্ছেন না। শ্রমিকদের আনতে তারা বেশি আগ্রহি। ট্রেনের গল্প ঘুরিয়ে ফিরিয়ে রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে যাচ্ছে। অধীর চৌধুরী বলতে পারলেন রেলমন্ত্রী নাকি তাকে বলেছেন মমতাদি আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। ট্রেন চাইছেন না। অমিত শাহ আর একধাপ এগিয়ে বললেন শ্রমিকদের নিয়ে ফেরা ট্রেনগুলিকে রাজ্যে ঢুকতে দিচ্ছেন না দিদি।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহ ও রেল মন্ত্রী পিযুষ গোয়েল বারবার বলছেন প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছেন যতদ্রুত সম্ভব শ্রমিকদের ঘরে ফেরাবার ব্যবস্থা করতে। কিন্তু রাজ্যসরকার সাহায্য না করলে তা সম্ভব নয়। দিদি যে সময় টুইট করে 105 টি ট্রেনের ব্যবস্থা করেছেন। রেলমন্ত্রী দাবী করছেন এই ট্রেন চাওয়া হয়েছে একমাসের জন্য। অর্থাৎ একমাস ধরে এই ট্রেনে দু-আড়াই লক্ষ লোক ফিরতে পারবে। যেখানে দরকার দুহাজার(2000) ট্রেন। এর আগে ন’টি ট্রেন শ্রমিক, ছাত্র ও তীর্থ যাত্রীদের নিয়ে রাজ্যে ফিরেছে। লক্ষাধিক লোক পায়ে হেটে ও ট্রাক ভাড়া করে ফিরেছেন।
তবে বিপুল অংশ ফিরতে পারেননি। এদের ফেরাতে দেরীতে হলেও রাজ্য সরকার এখন সচেষ্ট। কিন্তু এত শ্রমিক তাদের ফিরিয়ে আনা কতদিনে সম্ভব হবে তা চিন্তার বিষয় বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। যতটা দেরী হবে ততটাই বেকায়দায় পড়বে শ্রমিকরা। বেকায়দায় পড়বে রাজ্য সরকার। কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রী যে শ্রমিক কল্যাণ যোজনা ঘোষণা করেছেন তার সুবিধা পেতে ঘরে ফিরতেই হবে ভিন রাজ্যে থাকা বাংলার শ্রমিকদের। বিরোধীরাও হাত তুলে বসে থাকবে না। করোনা রাজনীতি বেশ জমে উঠেছে রাজ্যে রাজ্যে। বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে তো বটেই। পরিযায়ী শ্রমিকের সমস্যা পরিযায়ী পাখীদের মত সহজ সরল নয়।