ক্লাস নাইনে পড়াকালীন আমাদের ইতিহাসের প্রবীণ শিক্ষক সবসময় একটা কথা বলতেন। দেশের অসুখ হলে দেশের শরীর চেনা যায়। হ্যাঁ, আমাদের দেশের অসুখ করেছে। শুধু আমার দেশের নয়, আমার পৃথিবীর অসুখ করেছে। সারা পৃথিবী করোনা প্যান্ডেমিকে আক্রান্ত। এমন বড় অসুখ বোধহয় বিগত ১০০ বছরেও আর হয়নি। সারা বিশ্ব আপাত গৃহবন্দীদশায় রয়েছে। পৃথিবীর যান্ত্রিক গতি একপ্রকার স্থবির হতে চলেছে। পৃথিবীর প্রায় প্রত্যেকটা দেশ তার শারীরিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক পরিকাঠামোকে বাঁচাতে ব্যস্ত। এমনকি আমাদের দেশও তার অন্যথায় নয়। এমন স্থবিরতার দিনে আমাদের দেশের কিছু কিছু ঘটনা যেন অসামঞ্জস্যপূর্ণ হয়ে ওঠে। কেন এমন হয় প্রশ্ন করলে তার উত্তর খুঁজতে চোখ, কান সজাগ এবং সচেতন রাখা দরকার।
লকডাউনের প্রায় দুমাস হতে যায়। আরো কতদিন এমন বন্দীদশা চলবে কে জানে? সরকারী অনুরোধ বারবার প্রচার করা হয়েছে এবং হচ্ছে বিভিন্ন মিডিয়ার মাধ্যমে। এ অনুরোধ ঘরে থাকার অনুরোধ, ঘরে রাখার অনুরোধ। কিন্তু তারপরেও অদ্ভুত এক অবাধ্য অসহযোগীতার ছায়া এই রাজ্যের দিকে দিকে। এ ছায়াটাও আজ বড় সংক্রামক।
বাজারপ্রিয়, খাদ্যরসিক বাঙালীর ভিড় সকাল থেকে বাজার জুড়ে। বাজারের থলির সাথে সাথে বাজারে বয়স্ক মানুষের সংখ্যাও বেড়ে চলেছে। পাড়ার এক দাদুকে সেদিন সকালে বাজারে যেতে দেখে বাধ্য হয়ে বলেই ফেললাম, দাদু আপনি বয়স্ক মানুষ। আপনি কেন? কাকাবাবু বা ভাইরা তো যেতে পারে। আপনার জন্য বাইরে বেরোনোটা মোটেও সুরক্ষিত নয়। এতে দাদুর উত্তর শুনে আর কথা খুঁজে পেলাম না। দাদু তার অতীতে দেখা স্মৃতিকাঁপানো দুর্ভিক্ষর পরিস্থিতি ও পরিনাম বর্ণনা করতে লাগলেন। আমিও যেন ওনার চোখে আমাদের ভবিষ্যৎটা দেখতে পেলাম। হয়তো উনি ভবিষ্যৎ পরিস্থিতি আন্দাজ করেই রোজ ছুটছেন বাজারে যাতে তার পরিবারকে দুর্ভিক্ষপীড়িত না হতে হয়।
এই দৃশ্য কিন্তু দেশের অনেক রাজ্যেই চিন্তার কারণ হয়ে উঠছে, শুধু বাংলার নয়। তবে বাংলায় হইচই এর পরিমানটা অনেকটাই বেশি। এতো গেল বাজারবন্দনা, কিন্তু ব্যাঙ্কে রোজ এত ভিড় উপচে ওঠার কারণ কী? শুধুই কি আর্থিক লেনদেন নাকি বাড়ির বাইরে ঘুরে আসার প্রচ্ছন্ন অজুহাত।
মানুষ বারমুখো। তাই বাইরে বেরোনোর অজুহাত আপনিই তৈরি হয়ে যায়। কিন্তু ধর্মীয় উৎসব বা জমায়েত যখন অজুহাত হয়ে ওঠে তখন কিন্তু ব্যাপারটা আর সাধারণ থাকে না। মানুষও তখন আর মানুষ থাকে না। কেমন যেন মৃত্যুর দূত হয়ে ওঠে। লকডাউন চলাকালীন দেশের বিভিন্ন স্থানে এই ধর্মীয় জমায়েত বারবার প্রকট হয়েছে। জমায়েতের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ছে সংক্রমণ সারা দেশে। সেখানে কি শুধুই মানুষের ধর্মপ্রেম কাজ করেছে? না, এর আসল উদ্দেশ্য হল দেশের ও দশের কাছে নিজেদের ক্ষমতা জাহির করা। সরকারী নির্দেশ অবজ্ঞা করে এখনো বেশ কিছু জায়গায়, বেশ কিছু ধর্মীয় স্থানে বিভিন্ন সময়ে যে জনসমাবেশ গড়ে উঠছে তার মধ্যে বারবার প্রকাশ পাচ্ছে ক্ষমতার চোখরাঙানি। তারা বোঝাতে চায়, বলতে চায় যে তারা কাউকে ভয় পায় না। পরোয়া করে না রাজ্যকে, রাষ্ট্রকে, সংবিধানকে, আইনকে, প্রশাসনকে এমনকি ভয় পায় না করোনাকেও। অদ্ভুত প্রকৃতির এই জীবগুলো ধর্ম বলতে বোঝে মোনোপলি পাওয়ার আর ধর্মীয় গোঁড়ামির বাঁধভাঙা একছত্র আধিপত্য। সেখানে প্রশাসনিক বিধিবদ্ধতা, আইনকাউন, অনুরোধ, আদেশ কিছুই চলেনা, যেন সারা পৃথিবীর থেকে আলাদা হয়ে যাওয়া এক একটা ধ্বংসপুরী। সেখানে বসবাসকারী কিছু মানুষ দেশের প্রতিটা অঙ্গকে ধীরে ধীরে বিকল করে দিচ্ছে।
পাশাপাশি বেড়ে চলেছে সন্ত্রাস ছড়ানোর এক অদ্ভুত জেদ। সাধুহত্যা থেকে পুলিস বা ডাক্তার পেটানো যেন এরই এক চরম নিদর্শন। পুলিসফোর্স, র্য্ফবাহিনী যারা নিজেদের জীবন বিপন্ন করে রাস্তায় নেমেছে দেশকে সুস্থ করতে তারাও আজ এই ক্ষমতাবাহিত অরাজকতার শিকার। রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায়, বিভিন্নভাবে এরা আক্রান্ত হচ্ছেন জনজীবনকে সুস্থতা দিতে গিয়ে। এমনকী রাজ্যের মিল, ফ্যাকট্রি, কারখানাও রেহাই পায় নি এই আক্রমণের হাত থেকে। লকডাউন চলাকালীন জমায়েত থেকে ফেরা শ্রমিকদের চোদ্দদিনের কোয়ারন্টাইনে থাকতে বলায় মিল, ফ্যাকট্রি, কারখানা ভাঙচুর করা হয়। হত্যা করা হয় সুস্থতার আশ্বাস। এমন প্রত্যেকটা অনৈতিক আক্রমণের পিছনে জমাটবদ্ধ হয়ে আছে রাজনৈতিক মদতপুষ্ট ক্ষমতার আদৃশ্য আস্কারা। বিশ্বের কোনো সভ্য দেশে লকডাউন চলাকালীন এমন অরাজকতার নিদর্শন পাওয়া যায়নি, যাবেও না। এভাবে প্রশাসনের উপর আধিপত্য বিস্তারের স্পর্ধা, রাষ্ট্রিয় বিধিনিষেধের উপর ক্রমাগত আঘাত হানার দুঃসাহস সাধারণ মানুষকে ভাবিয়ে তুলছে, মানুষ ভয় পাচ্ছে সত্যি দেখতে, বলতে, লিখতে। জরুরীকালীন খাদ্যবন্টন থেকে স্বাস্থব্যবস্থা যেন শুধুই প্রহসন। সত্যিটা সবার জানা, শুধু বলতে ভয়। মহাভারতের একটি দুর্যোধনের মিথ্যে পরাক্রম আর ক্ষমতার দম্ভে কুরুবংশ ধ্বংস হয়েছিল। আজ রাজ্যের আনাচেকানাচে হাজার হাজার দুর্যোধন তাদের ক্ষমতার অপপ্রয়োগ করে চলেছে। তার পরিনাম কি আমরা সবাই বুঝতে পারছি না? তাহলে কুলুপ কেন মুখে? কোথায় এই আগ্রাসী বিপর্যয় রুখতে প্রশাসনের নিরপেক্ষ দক্ষতা?
অন্ধকারের এখনো কিছুই দেখিনি আমরা। এরপর লকডাউন উঠে গেলে আর করোনাপ্রকোপ ঠান্ডা হলে শুরু হবে আসল লড়াই। সে অন্ধকার একদিন বা একমাসের নয়। আর্থ-সামাজিক জনজীবন কর্মহীন, খাদ্যহীন, পুষ্টিহীন এক চরম বিপর্যয়ের মুখ দেখতে চলেছে। সেদিন হয়তো বাজার করার জন্য থলি থাকবে, থলি ধরার আর রান্না করার মানুষ থাকবে না। মন্দির, মসজিদ, চার্চ থাকবে, সেখানে যাবার মানুষ থাকবে না, মানুষকে সাবধান করার জন্য কেউ আর পথে নামবে না। সেদিন কোথায় থাকবে ক্ষমতার অপপ্রয়োগ? সন্ত্রাস তখন সন্ত্রাসীর বাড়ির দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে তাদের ভয়ের কারণ হয়ে উঠবে না তো?
সেদিন ঠিক বলেছিলেন মাষ্টারমশাই। ” দেশের অসুখ হলে দেশের শরীর চেনা যায়”। একটা অদৃশ্য ব্যাধি দেশের শরীর চিনিয়ে দিচ্ছে বারবার। পাশাপাশি চিনিয়ে দিচ্ছে শরীরী অঙ্গের পচনের কারণ। সচেতন না হলে এই পচন রোধ করা অসম্ভব। করোনার চেয়েও বেশি সংক্রামক এই পচন বাড়তেই থাকে কোষগুলোতে। পাপতোষণের নীতি যত জোরদার হয়, তত বেয়াড়া হয়ে ওঠে সমাজের অসম লড়াইটা।
সময় হয়েছে নড়েচড়ে বসার। দেশের ও দশের ভবিষ্যৎ সুরক্ষার জন্য মেরুদন্ড সোজা রেখে প্রতিবাদ করতে হবে সন্ত্রাসবাহিত দুর্নীতির আর রাজনৈতিক মদতপুষ্ট এই স্বৈরচারীতার বিরুদ্ধে। বাজারের থলির সংখ্যা কমানোর সাথে সাথে মানিব্যাগটিকেও আশ্বাস দিতে হবে দীর্ঘদিন ব্যবহারের। মন্দির, মসজিদ, গীর্জার দরজায় দাঁড়িয়ে ধর্মগুরুরা যেন সঠিক পথ দেখিয়ে বলতে পারেন ঈশ্বর, আল্লাহ, গড মানুষের মধ্যেই রয়েছে, রাস্তায় বা ধর্মস্থানে নয়। পাশাপাশি প্রশাসনকেও এগিয়ে আসতে হবে মানুষের অধিকার ও ক্ষমতার নির্ভেজাল সমানাধিকার নিয়ে। প্রয়োজনে কঠোর হতে হবে জাতি, ধর্ম নির্বিশেষে। মানুষ ভোটব্যাঙ্ক হিসেবে না, মানুষ হিসেবেই গ্রহণযোগ্যতা পাক । কারণ ভোটব্যাঙ্ক সেজে থাকা মানুষগুলোই ক্ষমতার অপপ্রয়োগ করে, স্বাধীনতাকে স্বেচ্ছাচারিতার পর্যায় নিয়ে যায়।
পরিশেষে এটুকুই বলার যে দেশের অসুখ হলে দেশের শরীর চেনা যায় ঠিকই, এটাও সত্যি যে এই সঠিক চেনাটাই আমাদের দেশকে সুস্থতার পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। তারজন্য চাই সচেতনতা, সহনশীলতা, সংযম। একটু ভাবি, অন্তত উন্নত দেশগুলোর করোনা পরিস্থিতি দেখে নিজেরা একটু সাবধান হই। আশা রাখি, একদিন সকালবেলা ঠিক দেশের শরীর, মাটির শরীর, পৃথিবীর শরীর সমস্ত অসুখ মুক্ত হবে। সেদিন একে অপরের পাশে দাঁড়িয়ে বলবো, তোমার ব্যথা আমার হোক, আমার খুশি তোমার হোক। সেদিন আর যাই থাক, পৃথিবী থেকে ব্যথা শব্দটা মিলিয়ে যাবে করোনার মতোই। সংক্রামিত হবে খুশি, আনন্দ আর সুস্থতা।
– শাশ্বতী ভট্টাচার্য
কবি, প্রাবন্ধিক,
শিক্ষিকা, অর্থনীতি বিভাগ
সেন্ট পলস মিশন স্কুল
কলকাতা