নিজস্ব সংবাদদাতা : ১৬২ বছর আগের কথা। আন্দুল রাজবাড়ির সাথে সখ্যতা ও পরিবারের কর্তার কালীপ্রেমে মাকড়দহের বন্দ্যোপাধ্যায় বাড়িতে শুরু হয়েছিল আনন্দময়ী মায়ের আরাধনা। সেই মাতৃ আরাধনা আজ পারিবারিক মিলনোৎসবের চেহারা নিয়েছে। ডোমজুড়ের বিপ্রন্নপাড়ায় ছিল বন্দ্যোপাধ্যায়দের জমিদারি। কালের নিয়মে জমিদারির অবসান ঘটলেও রয়েছে বিশাল বাড়ি ও মন্দির। বন্দ্যোপাধ্যায় বাড়ির রন্ধ্রে রন্ধ্রে ইতিহাস। পেশার তাগিদে বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবার ধীরে ধীরে গ্রাম থেমে শহরগামী হয়। সঙ্গে নিয়ে আসে তাদের মা আনন্দময়ীকেও। চিকিৎসক গোবর্ধন বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়িতে নতুন করে শুরু হয় বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারের কালীপুজো। বিস্তারিত জানতে নীচে পড়ুন…
শোনা যায়, গোবর্ধন বন্দ্যোপাধ্যায়কে মা স্বপ্নাদেশ দিয়ে বলিদানের স্থান দেখিয়ে দিয়েছিলেন। সেই স্থানেই এখনো বলিদান হয়। মা’য়ের মন ভরাতে থাকে ৩৫ রকম ভোগের আয়োজন। বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবার সূত্রে জানা গেছে, গত ১৬০ বছরেরও বেশি সময় ধরে এই প্রথা চলে আসছে বন্দ্যোপাধ্যায় বাড়িতে। দেবীর ভোগে থাকে ভাত, খিচুরি, লুচি, ১০ রকম ভাজা, পায়েস, শুক্তো, মুগ, মটর, অড়হর ডাল, ফুলকপি, বাঁধাকপি, লাউ, চালকুমড়ো, ঘন্ট, এঁচর অথবা মোচা, মাছের ঝোল, মাছের অম্বল, গুড় বড়ি, শোল মাছ পোড়া, মহাপ্রসাদ (ছাগ বলির মাংস)। সঙ্গে থাকে দই, রাবরি, ক্ষীর, চানাচুর, গুঁজিয়া, ছানা। পাশাপাশি দেওয়া হয় স্পেশ্যাল দু’রকমের নাড়ু। পরিবারের সদস্যরাই এই এলাহি আয়োজন করেন।
বাড়ির মেয়ে-গৃহবধূরা পুজোর তিন দিন আগে থেকে ভোগের তোড়জোড় শুরু করেন। কালের নিয়মে অরুণ, দেবদাস, বিপ্রদাস বন্দ্যোপাধ্যায়দের হাত থেকে এই পুজো এখন এসেছে অঞ্জনদের হাতে। অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ে বলেন,”গোবর্ধন বন্দ্যোপাধ্যায় ও তাঁর ভাইয়েরা পেশাসূত্রে হাওড়ার কদমতলায় চলে আসেন। পরিবারের বেশিরভাগ সদস্যই চলে আসেন কদমতলায়। গোবর্ধন বন্দ্যোপাধ্যায়কে মা স্বপ্ন দিয়ে পূজা থেকে বলিদানের স্থান সমস্তকিছুই দেখিয়ে দেন। গোবর্ধনবাবু ও তাঁর পরিবারের স্থানান্তকরনের সঙ্গে এই পুজোও চলে আসে ১২৬/১ মাকড়দহ রোডের ঠিকানায়। সেই বাড়িতেই প্রায় ৮০ বছরের বেশী সময় ধরে পুজো হচ্ছে। এখনও পুজোর জাঁকজমকে কোনও পরিবর্তন হয়নি। পরিবর্তন হয়নি পুজোর নিয়ম ও নিষ্ঠায়। এখনও নিয়ম মেনে বলিদান হয়। একসময় মোষ বলি হত।”
বাড়ির মেয়ে মৌমিতা দাস মুখোপাধ্যায়ের কথায়, “আমাদের পুজোর শরীরময় সাবেকিয়ানার দাপট। পঁয়ত্রিশ রকম ভোগের পদ, বলিদান, ধুনুচি পোড়া , বলিদানের আগের থমথমে আবহাওয়া, তারপরের উল্লাস। ঢাকের সাথে আমাদের পায়ের তাল, ধুনুচির ধোঁয়ার লহমায় সকলের উচ্ছাসময় আবেগ, সব কিছুর মিশ্রন এই সুপ্রাচীন পারিবারিক পুজো।” একদিকে যেমন রীতিনীতি, সাবেকীয়ানায় উজ্জ্বল এই সুপ্রাচীন পুজো, তেমনই এই পুজোকে কেন্দ্র কার্যত মিলনক্ষেত্রের চেহারা নেয় বন্দ্যোপাধ্যায় বাড়ি। বাড়ির সদস্যা অর্পিতা মুখোপাধ্যায়ের কথায়, এই পুজো আবেগের পূজো। পুজোর রাতে গা বেয়ে ঝরে হাজার হাজার কথা, গল্প, আড্ডা।
ছোট থেকে যৌবনের অনেক গোপন আবেগী কথার কানা কানি, ফিস ফিস। আবার সদ্য বড়ো হয়ে ওঠার সিম্বল স্বরূপ সিদ্ধি খাওয়ার রাতও বটে। পুজোর প্রাণ কিন্তু মা নিজে। এক গা গয়নায় সজ্জিত মা তার পূর্ণ গন্ধ, রূপ, আবেশ নিয়ে দুটো দিন আমাদের বাড়িতে বিরাজ করেন।” অনেক আদরে ভরা আবেগে মোড়া বন্দ্যোপাধ্যায়দের বাড়ির পুজো। ঝিকিমিকি ঝাড়বাতির জায়গায় স্থান পেয়েছে রঙবেরঙের মিনিয়েচার। চায়ের কেটলির জায়গায় এখন বোতাম টিপে চা, কফি, পুরোনো উঠান এখন সবুজ কার্পেটের তলায় গা ঢাকে। তবু পুজোর আড়ম্বর, পুরোনো গন্ধ , সাবেকিয়ানার গ্লাম্যার সব কিছু নিয়ে স্বমহিমায় এগিয়ে চলেছে বন্দ্যোপাধ্যায় বাড়ির পুজো। আর তারই প্রস্তুতিতে এখন বন্দ্যোপাধ্যায় বাড়িতে সাজো সাজো রব।