পৃথ্বীশরাজ কুন্তী: নির্ভীক চিত্তে কখনো মাঠে নেমেছেন বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে,কখনো বা সম্পূর্ণ একক প্রয়াসে নিজের বিদ্যালয়ে জাতীয় সঙ্গীত শুরু করেছেন,আবার স্থানীয় বাসিন্দাদের নিয়ে চোলাইয়ের ঠেক ভেঙেছেন।তার সাথে তিন তালাকের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে গেছেন।একই সঙ্গে বিদ্যালয়ে চালু করেছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ,নেতাজি এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মবার্ষিকী পালন।আর এসব করতে গিয়েই একরাশ বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছিল এই উদ্যোমী কর্মবীরকে। জুটেছিল মার।তাঁকে খুন হওয়ারও সম্মুখীন হতে হয়েছিল।তবুও তিনি তাঁর লক্ষ্য থেকে পিছপা হননি।মাথা উঁচু করে অদম্য লড়াই চালিয়ে গেছেন।আর তারই স্বীকৃতি স্বরূপ এবছর দেশের চতুর্থ সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মান ‘পদ্মশ্রী’তে ভূষিত হতে চলেছেন আমতার ভূমিপুত্র কাজী মাসুম আখতার।বর্তমানে কোলকাতার বাসিন্দা হলেও মাসুম বাবুর জন্ম গ্রামীণ হাওড়ার আমতা-১ ব্লকের বসন্তপুর গ্রামের কাজীপাড়ায়।সেখানেই বেড়ে ওঠা।তারপর ১৯৮৮ সালে বসন্তপুর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক পাস করে কোলকাতায় উচ্চশিক্ষা।ইতিহাসের কৃতি ছাত্র মাসুম আখতার পড়াশোনার পাশাপাশি ছাত্র রাজনীতিতে কোলকাতার অন্যতম মুখ হয়ে ওঠেন।বি.এড শেষ করেই স্কুল সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষায় পাশ করে তিনি শিক্ষক হিসাবে যোগ দেন দক্ষিণ ২৪ পরগণার লক্ষ্মীকান্তপুরের কাছে রায়পুর নরেন্দ্রনাথ বিদ্যামন্দিরে।সেখানে স্থানীয় মহিলাদের নিয়ে চোলাইয়ের ঠেক ভাঙতে উদ্যোগী হন।মুসলিম সমাজে শিক্ষার অগ্রগতির স্বার্থে কাজ করার লক্ষ্য নিয়ে প্রধান শিক্ষক হিসেবে মেটিয়াবুরুজের এক সরকার পোষিত মাদ্রাসায় যোগ দেন।আর তা থেকেই শুরু হয় আরেক লড়াইয়ের নতুন অধ্যায়। দিনটা ২০১৫ সালের ২৬ শে মার্চ।বিদ্যালয়ের প্রার্থনাসভায় পড়ুয়াদের জাতীয় সংগীত গাইয়ে আক্রান্ত হয়েছিলেন।স্কুল জুড়ে বহিরাগতদের অরাজকতা,স্থানীয় এলাকায় বাল্যবিবাহ বন্ধে বিশেষ উদ্যোগ নেওয়ায় তাঁকে বারবার টার্গেট করা হয়েছিল।লোহার রড দিয়ে মেরে মাথা ফাটিয়ে দেওয়া হয়।শুরু হয় আইনি লড়াই।পাশাপাশি,তিন তালাক বন্ধের অনুরোধে এক লক্ষ মানুষের স্বাক্ষর নিয়ে ছুটেছিলেন সুপ্রিম কোর্ট,রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে পরবর্তীকালে নিরাপত্তাজনিত কারণে রাজ্য সরকার ২০১৬ সালের মে’মাসে যাদবপুরের কাটজুনগর স্বর্ণময়ী উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসেবে বদলি করে।মাত্র ৩ বছরে রুক্ষ্ম শুষ্ক এক মরুর বুকে প্রাণের সঞ্চার ঘটান কাজী মাসুম আখতার।নিয়মিত অন্যায়ের বিরুদ্ধে কলম ধরেন এই প্রতিবাদী শিক্ষক।’গণশক্তি’ দিয়ে হাতেখড়ি;পরবর্তীকালে প্রথমসারির বিভিন্ন বাংলা সংবাদপত্র ছাড়াও ইংরেজি পত্রিকাতেও নিয়মিত অন্যায় ও ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে কলম ধরেছেন।এই অপ্রতিরোধ্য লড়াইয়ের স্বীকৃতি হিসেবে ২০১৭ সালে পেয়েছেন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ‘শিক্ষারত্ন’ সম্মান।পাশাপাশি পেয়েছেন অন্যান্য বহু সম্মান ও পুরষ্কার।আর এবার শিক্ষা ও সাহিত্যে ‘পদ্মশ্রী’ পুরস্কার পাচ্ছেন আমতার এই ভূমিপুত্র। মাসুম বাবুর কথায়, “মৌলবাদীদের দ্বারা হজরত মহম্মদকে মক্কায় তেরো বছর ধরে মারা হয়েছিল,যীশু খ্রিস্টকে ক্রুশবিদ্ধ করা হয়েছিল,রামমোহন রায়কে ঘর ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছিল,আমি তো তুচ্ছ মাস্টারমশাই।আমার জন্য এমন তো হবেই।আমি তার জন্য তৈরি আছি।কিন্তু,দেশ আমাকে শ্রদ্ধা করেছে,এটাই আমার প্রাপ্তি”।’পদ্মশ্রী’ পাওয়ার খবরে স্বভাবতই খুশি মাসুম বাবুর গ্রাম বসন্তপুর।বসন্তপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র কাজী মাসুম আখতারকে নিয়ে বিদ্যালয়ের গেটে টাঙানো হয়েছে অভিনন্দন বার্তা।বসন্তপুর গ্রামের পশ্চিমপাড়ার বাসিন্দা পেশায় ইতিহাসের শিক্ষক শেখ আব্দুর রহিম বলেন,”মাসুম আখতার আমাদের গর্ব।তাঁর সৌজন্যে দেশের দরবারে পৌঁছাল গ্রাম।তাঁর হার না মানা এই লড়াইকে কুর্নিশ”।অন্যান্য বছরের মতো এবারও বিদ্যালয়ে সরস্বতী পুজোর আয়োজনে অত্যন্ত ব্যস্ত তিনি।ব্যস্ততার মাঝেও ফোনে ‘উলুবেড়িয়া সংবাদ’-এর প্রতিবেদককে সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে সবশেষে আবেগতাড়িত গলায় জানালেন,”আমতা আমার শিকড়,আমার বোধ,আমার রক্ত,আমার চেতনা।বসন্তপুরের মাটিতেই আমার বেড়ে ওঠা।আমতার জন্য আগামী দিনে যদি কিছু করতে পারি তা আমার জন্য অত্যন্ত গর্বের ও আনন্দের হবে।”
নির্ভীক চিত্তে চালাচ্ছেন লড়াই,আমতার ভূমিপুত্র পেতে চলেছেন ‘পদ্মশ্রী’
Updated on: