শান্তিনিকেতনের সোনাঝুরি জুড়ে আজ শুধুই শূন্যতা! চরম সমস্যায় নীলা, আনসারির মতো কুটিরশিল্পীরা

By নিজস্ব সংবাদদাতা

Published on:

নিজস্ব সংবাদদাতা : শান্তিনিকেতনের অদূরেই আকাশমণি-শালের জঙ্গলের মধ্য দিয়ে কুলু কুলু শব্দে আপন ছন্দে বয়ে চলেছে কোপাই। কোপাইয়ের তীরেই সোনাঝুরি বা খোয়াই হাট। সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে সোনাঝুরি আজ অনেকটাই পরিচিতি লাভ করেছে। শান্তিনিকেতন এলে বেশিরভাগ মানুষই হাটে ঘুরে যান। দেখে যান শান্তিনিকেতন সংলগ্ন গ্রামগুলির শিল্প-সংস্কৃতির নিদর্শনকে।

দেশজুড়ে লকডাউন উঠে আনলক-৪ পর্ব শুরু হয়েছে। কিন্তু, পর্যটন ব্যবসার মতোই অনিশ্চিত শান্তিনিকেতনের সোনাঝুরি বা খোয়াই হাট। করোনার জেরে গত ১৫ ই মার্চ প্রশাসনের তরফে নির্দেশিকা জারি করে বন্ধ করে দেওয়া হাট। দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ থাকা পর্যটকবিহীন সোনাঝুড়ি আজ যেন প্রাণহীন, রুক্ষ্ম, শুষ্ক এক মরুভূমি। আর তার জেরেই চরম বিপাকে পড়েছেন হাটের বিক্রেতারা। হাট বসছে না। তাই সপ্তাহের অন্যান্যদিন সামান্য কিছু বিক্রির আশায় নিজেদের শিল্পকর্ম নিয়ে খোয়াইয়ের হাট চত্বরে হাজির হচ্ছেন গুটিকয়েক বিক্রেতা। দিনের শেষে কারুর একটা খরিদ্দার জুটছে আবার কারুর বা সেটাও জুটছে না। আর তার ফলেই চরম আর্থিক সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন এই কুটির শিল্পীরা।

নিজের হাতে বোনা কাঁথা নিয়ে হাটের মাঠে একান্তে বসেছিলেন মধ্যবয়স্কা নীলা সোরেন। নিজের শিল্পকর্ম দেখাতে দেখাতে নীলাদেবী বিষন্ন সুরে জানালেন, “আজ প্রায় ৬ মাস বেচাকেনা বন্ধ। যেটুকু সঞ্চয়ে ছিল সেটুকুও শেষ। কোনোরকমে রেশনের চালে দিন কাটছে। বাধ্যহয়েই কাঁথা নিয়ে মাঠে আসি। যদি কিছু বিক্রি হয়।” কিন্তু তাঁর আক্ষেপ, “করোনার ভয়ে সোনাঝুরি একেবারেই পর্যটকশূন্য। দিনে একটা বা দুটো সামগ্রী বিক্রি হচ্ছে। তাতে কি আর সংসার চলে!”

উল্লেখ্য, সোনাঝুড়িতে স্থায়ী দোকান নেই। কেউ ত্রিপল বা চট, কেউবা আবার মাটিতে শালপাতা বিছিয়ে পসরা সাজিয়ে বসেন। হাটের বিক্রেতারা প্রায় সকলেই প্রান্তিক উৎপাদক। হাটের স্থানীয় ক্রেতা নেই বললেই চলে। প্রায় সকলেই পর্যটক। আশপাশের গোয়ালপাড়া, পাটুলডাঙা, ভুবনডাঙা, প্রান্তিক, কোপাইসহ প্রায় ৮-১০ টি গ্রামের আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষ হাটে আসেন পসরা সাজিয়ে। মূলত নিজ হাতে তৈরি বিভিন্ন শিল্পকর্ম, মডেল, সূতিবস্ত্র, চিনামাটির বিভিন্ন সামগ্রী, বেতের ঝুড়ি, চুপড়ি সাজিয়ে নিয়ে বিক্রেতারা আসেন ‘সোনাঝুড়ি’-তে। বাউলের একতারা, খোল-করতাল, সাঁওতালী নৃত্য, মাদলের রব, ছিনাথ বহুরূপীদের আনাগোনা, হরেক রকমের পসরার বিকিকিনি কিমবা লালমাটির মাঝে বসে বিকিকিনি সব নিয়ে সোনাঝুড়ি হয়ে ওঠে একটুকরো সাজানো বাগান।

কিন্তু, সেই সাজানো সোনাঝুরিই আজ নিস্তব্ধ এক প্রাণহীন ফাঁকা মাঠ। সাইকেলে রেখে মহিলাদের সাজ বিক্রি করছিলেন বছর পঁয়ষট্টির আনসারি সাত্তার। তিনি বলেন, “পেটের টানে বেরোতেই হয়। আগের মালপত্র জমে রয়েছে। বিক্রি হয়নি। তাই খুব কম লাভেই সেগুলো বিক্রি করছি। তাতেও কেনার লোক নেই।” ব্যক্তিগত কাজে শান্তিনিকেতনে এসেছিলেন গ্রামীণ হাওড়ার রাকেশ মন্ডল। কাজ সেরে তিনি সোনাঝুরিতে ঘুরতে গিয়েছিলেন। পেশায় শিক্ষক রাকেশ মন্ডলের কথায়, “আগে বেশ কয়েকবার সোনাঝুরি এসেছি। কিন্তু, এইরকম ছন্দহীন মনে হয়নি। সর্বসাকুল্যে ৬-৮ জন বিক্রেতা আর ২-৩ জন পর্যটক।” কবে হাট বসার প্রশাসনিক ছাড়পত্র মিলবে, কবেই বা পর্যটকরা ভিড় করবেন শাল-সেগুনের বনের মাঝের এই ছোট্ট মাঠে, কবেই বা প্রাণ ফিরবে সোনাঝুরির —এখন এইসব প্রশ্নই ঘুরে বেড়াচ্ছে আনসারি, নীলাদের মনে।