পৃথ্বীশরাজ কুন্তী : রাবড়ি গ্রাম —নাম শুনেই অনেকের মনে ইতিমধ্যেই প্রশ্ন জাগতে শুরু করেছে গ্রামের নাম ‘রাবড়ি’? —নাহ, তা ঠিক নয়। রাবড়ি তৈরির সুখ্যাতির দরুণ মানুষের মুখে মুখেই এই ‘রাবড়ি গ্রাম’ নামের সূচনা। হাওড়া জেলার সীমান্ত লাগোয়া হুগলীর চন্ডীতলা ব্লক। চন্ডীতলা ব্লকের আঁইয়া গ্রামের বিভিন্ন পরিবারের রুটি-রুজি নির্ভর করে রাবড়ির উপর। এই গ্রামের ঘরে-ঘরে তৈরি হয় বাঙালির প্রিয় রাবড়ি। ভোরের আলো ফুট না ফুটতেই বিভিন্ন গ্রাম থেকে গোয়ালারা দুধের বড়ো বড়ো পাত্র সাইকেলে চাপিয়ে হাজির হন এই প্রত্যন্ত গ্রামের বাড়িগুলিতে।
অন্যদিকে, বাড়ির কর্তা-গিন্নিরা ভোর থেকেই তোড়জোড় শুরু করে দেন। বিশাল আঁচের উনুনে আঁচ দেওয়া থেকে বাসনপত্র ধোওয়া। তারপর একটু সকাল হলেই বড়ো বড়ো কড়াইয়ে ৮-১০ লিটার দুধ ঢেলে তা আঁচের উনুনে দীর্ঘক্ষণ ধরে ফোটানো হয়। ফুটতে ফুটতে সেই দুধ যখন ২-৩ লিটারে এসে ঠেকে তখন থেকে তালপাতার পাখায় হাওয়া করে সর ফেলা শুরু হয়। সেই সর শলার কাঠি দিয়ে সুনিপুণ কৌশলে তা তুলে নিয়ে জমিয়ে রাখা হয় কড়াইয়ের গায়ে। একটু ঠাণ্ডা হলে কড়াইয়ের গায়ে লেগে থাকা পুরু সর কেটে তা ভিজিয়ে রাখা হয় ক্ষীরে।
এভাবেই দিনরাত এক করে রাবড়ি তৈরির কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন প্রশান্ত, বিফল বালতিরা। তাঁদের তৈরি রাবড়িই কোলকাতা সহ বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে প্রতিদিন রওনা দিচ্ছে। রাবড়ি তৈরিতে এই গ্রামের খ্যাতি এতটাই যে বাংলার বিস্তীর্ণ এলাকার নামীদামি মিষ্টির দোকানে দিনের পর দিন রাবড়ির জোগান দিয়ে চলেছে আঁইয়া। এই গ্রামের প্রায় ৪৫-৫০ টি পরিবার এই পেশার সঙ্গে যুক্ত। তবে লকডাউনের জেরে চাহিদা বেশ কিছুটা কম।
অন্যদিকে কাঁচামালের দামও বেড়েছে। তাই বেশ কিছু পরিবার আপাতত কাজ বন্ধ রেখেছে। পুরুষদের পাশাপাশি বাড়ির মহিলারাও সমানভাবে রাবড়ি তৈরির কাজ করেন। রাবড়ির পাশাপাশি সরভাজাও তৈরি হয় গ্রামের বেশ কয়েকটি বাড়িতে। বহু মানুষই এর স্বাদ নিতে সটান চলে আসেন এই গ্রামে। এখানে সাধারণ দোকানের তুলনায় অনেকটাই কমে রাবড়ি মেলে। আর স্বাদেও অনন্য। এক প্রবীণ কারিগরের সাথে কথা বলে জানতে পারা গেল, গ্রামেরই বাসিন্দা মনসাচরণ বাগদীর হাত ধরেই এই গ্রামে রাবড়ির পথচলা। এরপর আর ফিরে তাকাতে হয়নি। তারপর সময় যত গড়িয়েছে রাবড়ি জগতে ততই বেতাজ বাদশা হয়ে উঠেছে হুগলীর এই গ্রাম।