গ্রামীণ হাওড়ার শিল্পীদের হাত ধরে ‘পুতুল’ রূপে বেঁচে থাকেন রানি ভিক্টোরিয়া

By নিজস্ব সংবাদদাতা

Published on:

নিজস্ব প্রতিনিধি : বঙ্গ সমাজ, সভ্যতা ও সংস্কৃতির অন্যতম উপাদান পুতুল। বহু প্রাচীনকাল থেকেই পুতুলের প্রচলন। বাংলার বিভিন্ন স্থানে খনন কার্য চালিয়ে পোড়া মাটির পুতুল পাওয়া গেছে। তার মধ্য দিয়েই প্রমাণিত হয় বাংলার জনসমাজকে পুতুলের মাধ্যমে চিত্রিত করার এক প্রবণতা সুপ্রাচীন কাল থেকেই চলে আসছে। বাংলার বুকে বিভিন্ন রকমের পুতুলের প্রচলন আছে। যদিও কালের নিয়মে আজ বেশিরভাগেরই ঠাঁই হয়েছে ইতিহাসের পাতায়, কিমবা মিউজিয়ামের টেবিলে। ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপের যুগে গ্রাম বাংলার বুক থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে পুতুলখেলা শৈশবগুলি। তাই ম্লান হয়েছে এই কুটীরশিল্প। যদিও, আজও শিল্পকে ভালোবেসে, পুতুল সংস্কৃতিকে ভালোবেসে দিবাকর পালের মতো শিল্পীরা বানিয়ে চলেছেন হাওড়া জেলার নিজস্ব ‘রানি পুতুল’।

উল্লেখ্য, গ্রামীণ হাওড়ার জগৎবল্লভপুর, পাতিহাল, নরেন্দ্রপুর সহ বিভিন্ন গ্রামে এককালে প্রচুর তৈরি হতো এই বিশেষ পুতুল। দেখতে বিষ্ণুপুরের পোড়ামাটি বা টেরাকোটার মতো মনে হলেও আদতে এটি একটি সম্পূর্ণ ভিন্ন ঘরানার পুতুল। এই পুতুল তৈরিতে দু’খোল ছাঁচ ব্যবহার করা হয়। পোড়ামাটির এই বিশেষ পুতুলটিকে গোলাপি রঙ করে তাতে অভ্র মেশানো হয়। মাথাজুড়ে কোঁকড়ানো চুল। তবে থাকে না কোনো পা। কোমর থেকে দেহের বাকি অংশ ঘাঘরা ঢাকা। কখনও কখনও দৃষ্টিনন্দন করে তুলতে মুকুটও পরানো হয়। এভাবেই হাওড়ার বিভিন্ন গ্রামে প্রস্তুত করা হত রানিপুতুল। কদর কমেছে রানি পুতুলের। তাই শিল্পীর সংখ্যাটাও তলানিতে ঠেকেছে।

আজ গুটিকয়েক মানুষের হাত ধরে বেঁচে আছে হাওড়া জেলার এই লোকশিল্প। রানি পুতুলের এই বিশেষ গঠন কিমবা নামকরণ নিয়ে বিভিন্ন মত আজও রয়ে গেছে শিল্পীদের মনে। শিল্পী থেকে পুতুল-গবেষক প্রায় সকলেই একবাক্যে স্বীকার করেন যে, মূলত কোনো রক্তমাংসের রানিই এই পুতুলের আদর্শ। আর সেই পথ ধরেই ইতিহাসের পাতা ঘাঁটলে এই পুতুলের নামকরণ বা প্রচলন সম্পর্কিত বিশেষ তথ্য উঠে আসে। ইংল্যান্ডের রানি ভিক্টোরিয়ার ভারতপ্রীতি তৎকালীন সমাজের বহু মানুষকেই মুগ্ধ করেছিল। রদ করেছিলেন ‘ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি’র শাসন। রানির এহেন উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছিলেন ভারতবর্ষের বহু মানুষ।

যার প্রভাব ভারতের শিল্প-সংস্কৃতি-সাহিত্যেও। লোকসংস্কৃতি গবেষকদের মতে, দক্ষিণ পাতিহাল ও জগৎবল্লভপুরের নরেন্দ্রপুর গ্রামের পুতুল শিল্পীরা যে পুতুল বানালেন তার মধ্যে নিয়ে এলেন রানি ভিক্টোরিয়ার দেহ-চুলের গঠন। আর এভাবেই হাওড়া জেলার সংস্কৃতিতে স্থান করে নিলেন কয়েক হাজার মাইল দূরে থাকা রানি ভিক্টোরিয়া। পল্লী বাংলার বুক থেকে পুতুল খেলা নির্ভেজাল শৈশব হারিয়ে গেলেও, দিবাকর বাবুদের মতো গুটিকয়েক শিল্পপাগল মানুষের হাতে ধরে হাওড়া জেলার শিল্প,সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ধারাকে বহন করে নিয়ে চলেছে রানি ভিক্টোরিয়ার স্মৃতিবিজড়িত এই ‘রানি পুতুল’।