পৃথ্বীশরাজ কুন্তী : সময়টা বিংশ শতকের সূচনা লগ্ন। বাংলা সহ ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে ক্রমশ মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন। এরই মধ্যে বঙ্গভঙ্গের ঘোষণা করলেন লড কার্জন। বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে গর্জে উঠল বাংলার মানুষ। আর সেই আঁচ এসে পড়ল সুপ্রাচীন বন্দর নগরী আমতার বুকে। মার্টিন রেল, পান্তুয়া, সতীপীঠ মেলাইচন্ডী মন্দির সমৃদ্ধ এই ঐতিহাসিক জনপদ জুড়ে প্রতিবাদের ঝড়। আরও বৃহত্তর ও সুসংগঠিত আন্দোলনের জন্য প্রয়োজন যুবশক্তির।
তাই আমতার ছাত্র-যুবদের এক ছাতার তলায় আনতে সারস্বত সাধনায় উদ্যোগী হলেন একদল তরুণ। বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদকে আরও সুসংগঠিত করতে শুরু হল বাগদেবীর আরাধনা। ১১৬ বছর অতিক্রম করে আজও একইভাবে পূজিতা হচ্ছেন দেবী সরস্বতী। সঙ্গে থাকেন ভারত মাতা। ১৯০৫ সালে মহাধুমধাম সহকারে অষ্টম পরী সহ ডাকের সাজে সুসজ্জিতা হয়ে মৃন্ময়ী মায়ের মন্ডপে আগমন ঘটে। ১৯০৫ সালের সেই প্রথম পুজোয় পৌরহিত্য করেন বঙ্কিম চক্রবর্তী। মাতৃ আরাধনা ও ভোগ প্রস্তুতির জন্য ক্রমে গড়ে উঠল মাটির ঘর।
তারই সঙ্গে সংহতি স্থাপনের উদ্দেশ্যে কিশোরীমোহন ঘোষ, কাশীনাথ সাউ, দেবেন চক্রবর্তী, কালী কুন্ডু, গৌর চট্টোপাধ্যায়দের নিরলস প্রচেষ্টায় আমতার দক্ষিণপাড়ায় গড়ে উঠল আমতা বাণী সংঘ নামক সামাজিক প্রতিষ্ঠান। দেবীর নামেই নবগঠিত সংগঠনের নামকরণ করা হল। ১৯০৫ সালের পর থেকে প্রতিবছরই ধুমধামের সাথেই পলাশপ্রিয়ার আরাধনায় মেতে ওঠে আমতার এই প্রাচীন সরস্বতী আরাধনার প্রাঙ্গণ। সংগঠনটির অন্যতম কর্তা শিক্ষক সুমন্ত সাউ জানান, “আমতার দক্ষিণপাড়ায় যে স্থানে দেবী সরস্বতী পূজিতা হতেন সেই স্থান সরস্বতীতলা হিসাবে জনমুখে পরিচিত লাভ করে। একসময় দেবীর আরাধনা উপলক্ষে এক সপ্তাহব্যাপী মেলা, যাত্রা, লেটোগান, তরজাগান, নাটক, নরণারায়ণ সেবাকে কেন্দ্র করে কার্যত আনন্দভূমিতে পরিণত হত আমতা বাণী সংঘ সংলগ্ন প্রাঙ্গণ।”
একইসঙ্গে তিনি বলেন, “১৯৬৬ সালে ভয়াবহ বন্যায় মাটির মাতৃমন্দির ভেঙে যাওয়ায় স্থানীয় মানুষের সহযোগিতায় সেবছরই পাকা ঠাকুর দালান গড়ে তোলা হয়।” দেবীর সঙ্গে থাকেন ছয় পরী। ছয় পরী যথাক্রমে ভারতমাতা, বঙ্গমাতা, দুই বেলপরী, জয়া এবং বিজয়া। শতাব্দীপ্রাচীন দেবীকে বিসর্জন করা হত বাঁশের ডুলিতে করে। এই পুজোকে কেন্দ্র আমতা ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের মানুষের সাড়া ছিল অভূতপূর্ব। দেবীর বিভিন্ন মহিমার কথা আজও লোকমুখে প্রচারিত হয়। প্রথমে বেতাই গ্রামের কেদার মিস্ত্রী ও পরে থলিয়া গ্রামের জীবন মিস্ত্রী ও তারঁ উত্তরসূরিরা মৃন্ময়ী মূর্তি তৈরি করতেন। স্থানীয় মানুষের বিশ্বাস, মা’কে যেমন সাজেই সাজানো হোক না কেন তিনি তাঁর স্বভাবসিদ্ধ চিরাচরিত রূপেই প্রতিভাত হন। ১১৬ বছর বহু পরিবর্তন হয়েছে দেশে। আড়ম্বর বেড়েছে গ্রামীণ সরস্বতী পুজোতেও। মাটির ঘরের পরিবর্তে মা আজ পূজিতা হন শ্বেতপাথরের দালানে, মা আজ বাঁশের ডুলির পরিবর্তে ট্রলিতে চেপে বিসর্জনের পথে পাড়ি দেন। কিন্তু, রয়ে গেছে শতবর্ষের ঐতিহ্য। আমতা বাণী সংঘের এই পুজো গ্রামীণ হাওড়ার বহু অজানা ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সাক্ষীরূপে আজও বর্তমান। আজও দেবীর আবির্ভাবকে কেন্দ্র করে তিনদিনব্যাপী বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের পাশাপাশি দুঃস্থ পড়ুয়াদের সম্বর্ধনা, বস্ত্রবিতরণ, রক্তদান শিবির, বিনাব্যয়ে চিকিৎসা শিবিরের মতো বিভিন্ন সামাজিক কর্মসূচীর আয়োজন করা হয়। তবে এবার ‘নিউনর্মাল’এ সমস্ত অনুষ্ঠান বাতিল করে কেবল মাতৃ আরাধনাটুকুই হবে বলে সংগঠন সূত্রে জানা গেছে। তবে অভিনব বিষয়, এবছর থেকে পুজোর আয়োজনের সমস্ত দায়িত্ব সংগঠনের মহিলা সদস্যারা নিজেদের কাঁধে তুলে নিয়েছেন। অনুষ্ঠান বাতিল হলেও ঐতিহ্য-আবেগে বিন্দুমাত্র ভাটা পড়েনি। তাই আবাহন থেকে বিসর্জন, এভাবেই দেবীর আরাধনায় মেতে উঠবে আমতা শহর।