– তাপস চট্টোপাধ্যায়
দিনটা ছিল 2009 সালের 31 শে মে ।তৎকালিন কেন্দ্রীয় রেলমন্ত্রী এবং এরাজ্যের বিরোধী নেতৃ মমতা বন্দোপাধ্যায় তৎকালিন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংএর কাছে দরবার করে জানিয়েছিলেন যে আয়লাবিধ্বস্ত পশ্চিমবঙ্গে কেন্দ্রীয় ত্রাণের জন্য বরাদ্দ অর্থ “রাজীব গান্ধী PM TO DM “ফরমূলায় রাজ্যকে দেওয়া হোক ।তাঁর মতে,অতীতে কেন্দ্রের যাবতীয় আর্থিক বরাদ্দই পশ্চিমবঙ্গের মার্কসবাদী ক্যাডাররা সাইফন পক্রিয়ায় খালি করে দেয় ।অতয়েব স্থানীয় স্তরে পঞ্চায়েত ,পুরসভার মাধ্যমে হস্তান্তরের সাথে সাথে তাদেরও জবাবদিহিতে বাধ্য করা হোক ।তৎকালিন এরাজ্যের অর্থমন্ত্রী অসীম দাসগুপ্ত বিরোধী নেত্রীর কেন্দ্রকে এজাতীয় কু-মন্ত্রণার ঘোর বিরোধিতা করেন ।তাঁর মতে ,পুরসভা এবং পঞ্চায়েত রাজ্যের এক্তিয়ারভূক্ত , সেক্ষেত্রে রাজ্যকে পাশ কাটিয়ে এইধরনের যে কোন পদক্ষেপই অসংবিধানিক । অবশ্য সেই সময়কালে যখন লোকসভা এবং বিধানসভা নির্বাচন মাথার শিয়রে তখন বিরোধী নেতৃর এজাতীয় পদক্ষেপ কতটা যুক্তিসঙ্গত সেটা এখন বিচার্য বিষয় নয় ।
আয়লার মতো ঘূর্ণিঝড়ের প্রলয়ঙ্করী তান্ডবলীলা একসময় বন্ধ হলেও কেন্দ্রীয় সরকারের আয়লা ত্রাণ প্যাকেজ নিয়ে এ রাজ্যে শাসক-বিরোধী দড়িটানাটানি উত্তরোত্তর বাড়তেই থাকে । রাজ্যের শাসকদলের তাবড় নেতারাও আয়লার চেয়েও ভয়ঙ্কর মমতাঝড় সামলাতে নাস্তানাবুদ হয়ে পড়ে ।ওদিকে বিরোধী নেতৃ তখন শুধুমাত্র প্রধানমন্ত্রীর কাছে অভিযোগ জানিয়েই ক্ষান্ত হন না,তৎকালিন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রনব মুখার্জী থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রী এ.কে.অ্যানটনি , কেন্দ্রীয় সরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিতাম্বরমের কাছেও একই অভিযোগে মুখর হন ।অবশেষে সিদ্ধান্ত হয় ,কেন্দ্রের একটি বিশেষ দল পশ্চিমবঙ্গের আয়লাবিধ্বস্ত অঞ্চলের যাবতীয় ক্ষয়ক্ষতির সরজমিনে তদন্তের পরই আয়লার ত্রাণ প্যাকেজের পরিমান স্থির করা হবে । পশ্চিমবঙ্গের বামফ্রন্ট সরকার অবশ্য চুপচাপ বসে থাকে না ।তৎকালিন রাজ্যের অর্থমন্ত্রী অশীম দাসগুপ্ত আয়লা বিপর্যয়কে অবিলম্বে ” জাতীয় বিপর্যয়” ঘোষনা করে 1000 কোটি টাকার ত্রাণ প্যাকেজের দাবী তোলেন ।তাঁর দেওয়া হিসাবমতো রাজ্য ইতিমধ্যেই তার নিজস্ব ” ক্যালামিটি রিলিফ ফান্ড” থেকে 61 কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে কিন্তু আয়লায় ক্ষয়ক্ষতিকে বিচার করে ত্রাণ এবং পূনর্নিমানের জন্য প্রয়োজন 1500 কোটি ।রাজ্যের এই ব্যাখানে বিরোধী নেতৃ মোটেই খুশী হন না ।তৎকালিন কংগ্রেস সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধীর সাথে বিশেষ ঘনিষ্টতার সুবাদে পশ্চিমবঙ্গের 1000 কোটি ত্রাণের দাবী নস্যাৎ করার যাবতীয় ফন্দিফিকির খুঁজতে চেষ্টার ত্রুটি রাখেন না । তাঁর মতে,এটা বন্ধ হওয়া উচিৎ ।বিপর্যয়ের খতিয়ান সঠিকভাবে পর্যবেক্ষনের জন্য সঠিক দায়িত্বশীলতা এক্ষেত্রে অত্যন্ত জরুরী ।বিরোধীনেতৃ শুধুমাত্র বিরোধিতা করেই থেমে থাকেন না,ক্ষয়ক্ষতির বাস্তব চেহারা পর্যবেক্ষন এবং হিসাবের জন্য নিজের দলের একাধিক মন্ত্রীগোষ্ঠীকে আয়লাবিধ্বস্ত অঞ্চল পরিদর্শনের সিদ্ধান্ত নেন ।অবশেষে বিরোধীনেতৃ কেন্দ্রীয় ত্রাণপ্যাকেজের অনেকটাই সংকুচিত করতে সফল হন । প্রধানমন্ত্রীর জাতীয় ত্রাণ তহবিল (PM NATIONAL RELIEF FUND) থেকে আয়লায় 180 জন মৃতদের পরিবার পিছু 2 লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ,ঘূর্ণিঝড় বিধ্বস্ত পরিবারের ওষুধপত্র এবং শিশু আহারের জন্য 19.94 লক্ষ। এছাড়াও রাজ্যের আয়লায় ক্ষতিগ্রস্থ তিন জেলায় 200 টি সাইক্লোন সেন্টার তৈরির জন্য 138.65 কোটি সরাসরি জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা সংস্থা ( NDMA) কে দেওয়া হয় ।
প্রয়াত কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লিখেছিলেন , ” রাজা আসে যায় রাজা বদলায় নীল জামা গায় লাল জামা গায় এই রাজা আসে ঐ রাজা যায় জামাকাপড়ের রং বদলায় …..দিন বদলায় না । “
দশকের পর দশক অতিক্রান্ত হয়,ঝড় আসে ঝড় যায় ।আয়লা,ফণি,বুলবুল, ঝড়ের নামের সাথে রাজাও বদলায় ।সিঁড়ি ভাঙা অঙ্কের মতো আবাহদপ্তরের সতর্কিকরণ, পূনর্বাসন,ত্রাণ,পূনর্গঠনে কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ হয়।কিছু বাস্তবায়িত হয় ,কিছু খাতায় কলমেই থেকে যায় ।সরকারি সহায়তায় উপকুলের ভিটেছাড়া পরিবারগুলো সাময়িক ত্রাণশিবিরে বসে ঝড় শেষ হওয়ার প্রহর গোনে ।তারপর আবার শুরু হয় ঘর বাঁধার কাজ,জীবনের সাথে সাথে জীবিকাকে সচল রাখার আপ্রাণ প্রচেষ্টা ।প্রশাসনের হোমরাচোমরা থেকে রংবেরঙের ঠিকেদার ,ঘরদোয়ার থেকে বাঁধ মেরামতি,গোঁজামিলে কেটে যায় কয়েকটা বছর ।আবার একটা ঘূর্ণিঝড়ের সতর্কবার্তা,হাতের কাছে সামান্ন সম্বলটুকু নিয়ে ত্রাণশিবিরে আশ্রয়,সরকারি ভরনপোষনে কয়েকটা দিন কাটিয়ে আবার ঘরে ফেরা ।প্রজন্মের পর প্রজন্ম জীবনের এই ঘূর্ণিপাকে অনেকটাই অভ্যস্ত ।
আয়লা এখন অতীত, ফণি,বুলবুলের ধাক্কা সামলে উপকুলের মানুষ এখন ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের মুখোমুখি ।এরই মধ্যে গঙ্গা যমুনায় অনেকটা জল বয়ে গেলেও রাজ্য বনাম কেন্দ্রের সমিকরণটা একটুও বদলায়নি ।শুধু বদলে গেছে রাষ্ট্রপ্রধানদের মুখগুলো । কেন্দ্রে ক্ষমতাশীন কংগ্রেসের জায়গায় একছত্র আধিপত্যে বিজেপি ,স্বল্পাভাসী প্রধানমন্ত্রী ডঃ মনমোহন সিং এর আসনে বাকপটু নরেন্দ্র মোদী ,এরাজ্যে সেদিনের বিরোধী নেতৃ আজ রাজ্যের মূখ্যমন্ত্রী ।আম্ফান তার স্বভাবসিদ্ধ ধ্বংশলীলা চালিয়ে অতিক্রান্ত ,একই হেলিকপ্টারে আম্ফান বিধ্বস্ত অঞ্চল পরিদর্শনে প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী সয়ং রাজ্যের মূখ্যমন্ত্রী ।আম্ফানে মৃতদের পরিবার পিছু 2 লক্ষ টাকা এবং আহতদের 50 হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ ।এছাড়াও প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে 1000 কোটি টাকার ঘোষনা আপাতদৃষ্টিতে কেন্দ্ররাজ্যের সৌহার্দপূর্ণ পরিবেশে রাজনৈতিক ঝড়ের কোন পূর্বাভাষ জানাচ্ছে না । আড়ালে আভাসে অবশ্য রাজ্যের বিরোধীরা ত্রাণবরাদ্দের সঠিক খরচের ব্যাপারে অনেকটাই সন্দিহান । এখন শাসক-বিরোধী রাজনৈতিক ঝড়ের প্রাবল্য কতটা ধ্বংশাত্মক হবে সেটাই রাজ্যবাসীর কাছে উৎকন্ঠার বিষয় ।