বিশেষ প্রতিবেদন : সত্যিই এযেন স্বপ্নের সোপান। দীর্ঘ কয়েক দশকের স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে। রাত পোহালেই কোটি কোটি বঙ্গবাসীর স্বপ্নের সেতু উন্মোচনের পথে। সেতু শুধু বন্ধন নয়, আত্মনির্ভরতার এক অনন্য প্রতীক। বহু প্রতিকূলতাকে উপেক্ষা করে প্রমত্ত পদ্মার বুকে ‘পদ্মা সেতু’ তৈরি করে বিশ্ববাসীকে তা-ই যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখা হাসিনার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ সরকার। বিস্তারিত জানতে নীচে পড়ুন...
১৯৭৫ থেকে ২০২২ — এই পাঁচ দশকে শেখ হাসিনার পথচলা খুব একটা সহজ ছিলনা। বাবা সহ পরিবার-প্রিয়জনদের হারানো, দেশছাড়া হওয়া, তারপর দেশে ফিরে ‘সোনার বাংলা’ গড়ার স্বপ্ন বোনা। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও বিভিন্ন ষড়যন্ত্র বারবার আছড়ে পড়েছে বঙ্গবন্ধু কন্যার উপর, তেমনই পিছু ছাড়েনি দেশের বিভিন্ন অভ্যন্তরীণ সমস্যা। সমস্ত কিছুকে উপেক্ষা করে যোগ্য প্রধানমন্ত্রী রূপে বাংলাদেশকে নতুন দিশা দেখানোর শপথ নিয়ে এগিয়ে চলেছেন শেখ হাসিনা। বাংলাদেশের অগ্রসরের ইতিহাসে পদ্মা সেতু কেবলমাত্র এক অবিস্মরণীয় অধ্যায়ই নয়, এক অনন্য মাইলস্টোনও বটে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নতি সাধনের লক্ষ্যে ও দেশের রাজধানী ঢাকার সাথে বাংলাদেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সাথে সড়কপথে সরাসরি সংযোগ স্থাপনের লক্ষ্যে গত শতকের একদম শেষ লগ্নে প্রমত্ত পদ্মার বুকে সেতু তৈরির পরিকল্পনা নেওয়া হয়। প্রাথমিকভাবে ১৯৯৯ সালের জুলাই মাসে সেতুর নির্মাণকাজ শুরু ও ২০০৪ সালের জুনে শেষ করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়। কিন্তু বিভিন্ন কারণে তা ক্রমশ বিলম্বিত হতে থাকে। অবশেষে ২০০১ সালের ৪ ঠা জুলাই মুন্সিগঞ্জের মাওয়ায় পদ্মা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বাংলাদেশের যমুনা নদীর উপর বঙ্গবন্ধু বহুমুখী সেতু তৈরিতে অর্থনৈতিকভাবে সহযোগিতা করেছিল বিশ্ব ব্যাঙ্ক। পদ্মা সেতু নির্মাণেও বিশ্বব্যাঙ্ক এগিয়ে আসে। কিন্তু, বেশ কয়েক বছরের মধ্যেই হঠাৎই ঘনিয়ে আসে অন্ধকার। ব্রিজ তৈরিতে ব্যাপক দুর্নীতি হচ্ছে — এই অভিযোগ তুলে ঋণদান থেকে সম্পূর্ণভাবে সরে আসে বিশ্বব্যাঙ্ক সহ বিভিন্ন সংস্থাগুলি। এর জেরে কার্যত দিশেহারা হয়ে যায় নির্মীয়মান পদ্মা সেতুর ভবিষ্যৎ। এরপরই কার্যত চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে মাঠে নামেন শেখ হাসিনা। ২০১৪ সালের শেষ দিক থেকে সম্পূর্ণ বাংলাদেশের নিজস্ব অর্থে এই অসাধ্য সাধনের লক্ষ্যে এগিয়ে চলেন বঙ্গবন্ধু কন্যা। নির্মাণ কাজের দায়িত্ব দেওয়া হয় চিনের একটি কোম্পানিকে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, পদ্মা ভীষণ খরস্রোতা নদী। সেই নদীর উপর প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ৬.১৫ কিমি(সেতুর প্রস্থ ২২ মিটার) দীর্ঘ ব্রিজ তৈরি করাটাও একটা বিরাট রকমের চ্যালেঞ্জ। এই ব্রিজে বসানো হয়েছে ৪২ টি পিলার। রয়েছে ৪১ টি স্প্যান। জলের নীচে ১২২ মিটার অব্ধি গভীরে গিয়েছে এই পিলারের ভীত। রয়েছে ভূমিকম্প প্রতিরোধ ব্যবস্থা সহ বিভিন্ন অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার। নদীর কাছাকাছি হলেও রেলব্রিজ থেকে জলের নূন্যতম দূরত্ব থাকবে ১৮ মিটার। ফলে জলস্তর বাড়লেও অনায়াসেই ব্রিজের নীচে দিয়ে প্রায় চারতলা উচ্চতাবিশিষ্ট জাহাজ অনায়াসেই যেতে পারবে। ব্রিজটি দ্বি-তল বিশিষ্ট। ব্রিজের উপর অংশ দিয়ে ছুটে যাবে বাস, লরি সহ বিভিন্ন গাড়ি। আর নীচের অংশ দিয়ে এগিয়ে চলবে ট্রেন। ব্রিজটিকে বিভিন্ন আলোয় সাজানো হয়েছে। সেতু রক্ষণাবেক্ষণের জন্য রয়েছে টোল আদায়ের ব্যবস্থা। পদ্মা সেতুর একপ্রান্তে রয়েছে মুন্সীগঞ্জের মাওয়া, অপর প্রান্তে রয়েছে শরিয়ৎপুরের জাজিরা। শুধু সেতু নির্মাণেই নয়, সেতুর দু’ই প্রান্তের মানুষের পুর্নবাসনেও অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে বাংলাদেশ সরকার। সেতুর দু’দিকেই অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে সুসজ্জিত টাউন গড়ে তোলা হয়েছে। সেতু তৈরিতে যাদের জমি অধিগ্রহণ করেছে সরকার, তাদের বাসস্থান এবং বিকল্প কর্মসংস্থানেরও ব্যবস্থা করেছে সরকার। গড়ে উঠেছে একাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, থানা (পদ্মা সেতু উত্তর ও পদ্মা সেতু দক্ষিণ) সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। সেতুর দু’প্রান্তে ১৪ কিমি দীর্ঘ সংযোগকারী রাস্তা তৈরি করা হয়েছে। ব্রিজটির নির্মাণকাজ সম্পন্ন হতে সময় লেগেছে ৭ বছর ৬ মাস ২৬ দিন। পদ্মা সেতু কেবল পদ্মার দু’প্রান্তের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করছেনা, দেশের অর্থনৈতিক উন্নতিতে অন্যতম হাতিয়ার হিসাবে আত্মপ্রকাশ করতে চলেছে। পদ্মা সেতু চালু হওয়ার ফলে বাংলাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থায় এক আমূল পরিবর্তন ঘটতে চলেছে। এর ফলে খুব সহজেই কৃষিজ পণ্য, শিল্পের কাঁচামাল, শিল্পজাত পণ্যসামগ্রী সহজে ও স্বল্প ব্যয়ে স্থানান্তর করা যাবে দেশের এক।প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে। পদ্মা সেতু দিয়ে ট্রেন চলাচল করলে সেক্ষেত্রে ঢাকা ও চট্টগ্রামের সাথে যুক্ত হবে মোংলা ও পায়রা বন্দর। ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ের ক্ষেত্রেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেবে পদ্মার উপর তৈরি এই সেতু। ফলে বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে যে আমূল পরিবর্তন ঘটতে চলেছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা। আগে পদ্মা নদী পেরিয়ে ঢাকা আসতে বড়ো লঞ্চের জন্য ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করতে হত, এখন তা কয়েক মিনিটেই পেরানো যাবে। আগে কোলকাতা থেকে ঢাকা যেতে সময় লাগত প্রায় ন-দশ ঘন্টা। সেতু চালু হলে সেটা কমে দাঁড়াবে ছ’ঘন্টায়। সর্বোপরি, বিশেষজ্ঞদের মতে, পদ্মা সেতু বাংলাদেশের জাতীয় উৎপাদনকে (জিডিপি) ১.২৩ শতাংশ বাড়িয়ে দিতে পারে, যা সারা বিশ্বের বুকে এক ইতিবাচক দিক। এভাবেই পদ্মা সেতুর মাধ্যমে বাংলাদেশের বুকে একটি নতুন অর্থনৈতিক করিডরের সূচনা হতে চলেছে। অন্যদিকে, দেশের পর্যটনেও জোয়ার আনতে পারে এই নবনির্মিত সেতু। বিশেষত, বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্ত সুন্দরবনের পর্যটন নতুন রূপে জেগে উঠবে।
স্বপ্নের পদ্মা সেতু বাংলাদেশের শুধু নয়, আপামর বাঙালির আত্মমর্যাদা ও আত্মনির্ভরতার অন্যতম নিদর্শন। পদ্মা সেতু আপামর বাংলার গর্ব। বাংলাদেশের আর্থসামাজিক অগ্রগতির অন্যতম হাতিয়ার। শেখ হাসিনা পদ্মা সেতু তৈরির মাধ্যমে কার্যত সারা বিশ্বের তাবড়-তাবড় রাষ্ট্রকে ও রাষ্ট্রনেতাদের দেখিয়ে দিয়েছেন, বাঙালিরাও পারে, নিজস্ব দেশীয় অর্থে একটা স্বপ্নের সোপান তৈরি করতে। পদ্মা সেতুর উন্মোচন সারা বাংলাদেশবাসীর কাছে এক ঐতিহাসিক মুহুর্ত। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ভয়াবহ বন্যার কারণে সারাদেশ হয়ত এই আনন্দে সামিল হতে পারছেনা, তবু এ এক কালজয়ী মুহুর্ত হয়ে থাকবে। আদিকাল থেকে বাঙালির ভাঙা-গড়ার ইতিহাস জুড়ে পদ্মা যেমন বহমান, তেমনই বাংলা সাহিত্যজুড়ে পদ্মার উপস্থিতি। কখনো পদ্মার বুকে বসে কবিগুরু লিখেছেন একের পর এক কবিতা, ছোটো গল্প, আবার কখনো ‘কীর্তিনাশা’ পদ্মার পাড়ে বসবাসকারী ধীবর সম্প্রদায়ের মানুষদের জীবনকথাকে ‘পদ্মা নদীর মাঝি’তে ফুটিয়ে তোলেন বাঙালি কথাসাহিত্যিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। এবার সেই পদ্মার বুকেই রাত পোহালেই আত্মপ্রকাশ করতে চলেছে কোটি কোটি বাঙালির স্বপ্নের ‘পদ্মা সেতু’।