ড. সৌরভ দোয়ারী : বিগত কয়েকদিন ধরে গ্রামীণ হাওড়ার উদয়নারায়নপুর ব্লকের দামোদর নদী ও একাধিক জলাশয়ে ধরা পড়েছে ক্রোকোডাইল মাছ। আর তাতেই বাড়ছে চিন্তা। লোরিক্যারিডি গোত্রের সাকার মাউথ ক্যাটফিস স্থানীয়ভাবে ‘ক্রোকোডাইল’ মাছ নামে পরিচিত। এই মাছ নদী ও পুকুরের বাস্তুতন্ত্রের পক্ষে অত্যন্ত ক্ষতিকারক। উদয়নারায়ণপুর ব্লকের খিলার বাসিন্দা পেশায় শিক্ষক শ্যামল জানা কয়েকদিনের ব্যবধানে বেশ কয়েকটি ক্রোকোডাইল মাছ উদ্ধার করেন। তিনি পরিবেশের কথা ভেবে মাছগুলোকে পুকুর বা নদীতে না ছেড়ে বাড়ি সংলগ্ন ছোট কুয়োতে ছেড়েছেন। আদপে এই মাছ দক্ষিণ আমেরিকার বাসিন্দা হলেও ভারতের জলাশয়গুলোতে ছড়িয়ে পড়েছে মূলত শখের একোরিয়ামকারীদের অসচেতনতা ও অদূরদর্শীতার ফলে।
সাধারণত ট্যাঙ্কের নোংরা খেয়ে পরিস্কার রাখা ও দেখতে অদ্ভুত হওয়ার জন্য এই মাছ শখের একোরিয়াম প্রেমীদের কাছে অত্যন্ত প্রিয়। কিন্তু, এদের খুব তাড়াতাড়ি বৃদ্ধি ঘটে। যার জেরে একটু বড় হলেই একোরিয়ামে প্রতিপালনে অসুবিধা হয়। আর সেই অসুবিধার কারণেই সাধারণত এদের পার্শ্ববর্তী জলাশয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। যেহেতু সাধারণ মানুষ এই মাছ খেতে একেবারেই পছন্দ করেন না তাই সাধারণত কোথাও ধরা পড়লে পুনরায় কোনো জলাশয়ে ছেড়ে দেওয়ার প্রবণতা দেখা যায়। যদিও শ্যামল বাবু এক্ষেত্রে ব্যতীক্রমী পদক্ষেপ নিয়ে পরিবেশ সচেতনতার নিদর্শন রেখেছেন।
উল্লেখ্য, ক্রোকোডাইল মাছ স্থানীয় জলাশয়ে ছড়িয়ে পড়ে দেশীয় মাছ ও অন্যান্য জলজ প্রাণীর বাসস্থান দখল করে। এমনকি খাদ্য সংকট পর্যন্ত ঘটাতে পারে। এরা যেকোনো জলজ পরিবেশের সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নিতে সক্ষম। অল্প জল কিমবা দূষিত জল —সব জায়গাতেই দিব্যি বেঁচে থাকতে পারে। এমনকি পুরো জলজ খাদ্যশৃঙ্খলকে খুব সহজেই নষ্ট করে দিতে পারে। জলজ উদ্ভিদেরও প্রভূত ক্ষতি করার পাশাপাশি তাদের স্বাভাবিক বিস্তারও পরিবর্তিত করে দিতে পারে এই প্রজাতির মাছ। আবার জলাশয়ের পাড়ের ভুমিক্ষয়ও করতে পারে। তবে এই সমস্যা নতুন নয়। মূলত নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিকে থেকেই এই সমস্যা শুরু হয়েছে বলে মনে করেন অধ্যাপক সৌম্য সরকার। সৌম্য সরকার জানান, “আমাদের পরিবেশে এরা সহজেই প্রজনন সফলতা পায় এবং এক জলাভূমি থেকে অন্যত্র ছড়িয়েও পড়ে বেশ তাড়াতাড়ি। তাছাড়া বেশিরভাগ অঞ্চলেই এদের খাওয়া হয় না, সেটা এদের বাড়বাড়ন্তের অন্যতম কারণ। পূর্ব কলকাতার ভেড়িগুলো তে এদের পপুলেশন বর্তমানে যথেষ্ট বেশি।”
পূর্ব কলকাতা জলাভূমির ভেড়িগুলো সহ দক্ষিণবঙ্গের জলাভূমি গুলিতে শ’য়ে শ’য়ে সাকার মাউথ ক্যাটফিশ ছড়িয়ে পড়েছে। বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের বিশিষ্ট গবেষক নীলাঞ্জন দাস এদের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়া দেখে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। নীলাঞ্জন বাবু বলেন, “এই মাছের আমদানি বন্ধ করতে পারলে খুব ভালো হয়।” কোনো জায়গায় ক্রোকোডাইল ফিস ধরা পড়লে তিনি এদের কিছু বিকল্প ব্যবহারের কথা জানান। নীলাঞ্জন দাসের কথায়, “ধরা পড়ার পর সর্বদা নোংরা আবর্জনা জাতীয় জলাশয়ে রাখা যেতে পারে। দেখতে হবে সেটা কোনো ভাবেই সাধারণ জলাশয়ে না মেশে। মাছ চাষের আগে, পুকুরের আবর্জনা পরিষ্কারের কাজে লাগানো যেতে পারে, মশার লার্ভা নষ্ট করার কাজে জমা জলাশয়ে ব্যাবহার করা যেতে পারে। যদিও এই কাজের জন্য এখানকার অনেক প্রজাতির মাছ আছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন। তবে ক্রোকোডাইল ফিসের হাত থেকে পুকুর কিমবা নদীর বাস্তুতন্ত্রকে বাঁচাতে সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা গড়ে তোলাই সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক ও গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন পরিবেশবিদরা।
লেখক পরিচিতি ড. সৌরভ দোয়ারী, বিশিষ্ট প্রাণী গবেষক ও পরিবেশবিদ