নিজস্ব সংবাদদাতা : অনিমেষ,শুকুর,শম্পাদের কেউ এসেছেন ক্যানিং থেকে,কেউবা হাসনাবাদ আবার বা কাকদ্বীপ থেকে। সাথে নিয়ে এসেছেন বিভিন্ন ধরণের কাঁকড়া।কোনোটা ৩০০ গ্রাম সাইজের কোনোটা আবার ১০০ গ্রামের।
সাথে আলুরদম,শুটকি মাছ,বিভিন্ন সাইজের পোনা মাছ থেকে শুরু করে রয়েছে শাঁখালু,কুল,মাছের জাল। অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসাবে জিলিপি,পাঁপড়,খেলনা সহ বিভিন্ন সামগ্রী তো রয়েইছে।
আর এসবের টানেই শীতের আমেজকে গায়ে মেখে বিভিন্ন জেলার লক্ষাধিক মানুষ ভিড় জমিয়েছেন গ্রামীণ হাওড়ার উদয়নারায়ণপুর ব্লকের সিংটী গ্রামের সুপ্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী ভাই খাঁ পীরের মেলায়।
উল্লেখ্য,প্রতিবছর পয়লা মাঘ সিংটী খাঁ পাড়ায় বিস্তীর্ণ জমির উপর ৫০০ বছরেরও প্রাচীন ও ঐতিহ্যশালী এই মেলা অনুষ্ঠিত হয়।
মেলার ইতিহাস ঘাঁটলে জানা যায়,আরব থেকে এসেছিলেন ভাই খাঁ। তিনি তাঁর কাজের মধ্য দিয়ে স্থানীয় মানুষের মন জয় করেছিলেন।
৩০ শে পৌষ ভাই খাঁ মারা যাওয়ার পর ১ লা মাঘ তাঁর শেষকৃত্যে বহু মানুষ ভিড় জমিয়েছিলেন।আর তা-ই মেলার আকার ধারণ করে।
এভাবেই সূচনা ঘটে এই সুপ্রাচীন মেলার।মেলায় কাঁকড়া বিক্রির এই অভিনব রীতির পিছনেও আছে বেশ কিছু কারণ।
স্থানীয় মানুষের সাথে কথা বলে জানা যায়,আদতে পীর সাহেবের মেলা হলেও এলাকাটি হিন্দুপ্রবণ।
ইসলাম ধর্মাবলম্বী মানুষের পাশাপাশি মেলায় ভিড় জমাতেন অসংখ্য হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষ।আর তাঁদের জন্যই মেলায় শুরু হয়েছিল কাঁকড়া বিক্রির এই অভিনব রীতি।
একদিনের এই মেলায় সকাল থেকেই ভিড় জমাতে শুরু করেন আশপাশের বিভিন্ন গ্রামের কয়েক হাজার মানুষ।পার্শ্ববর্তী হুগলী,মেদিনীপুর জেলা থেকেও আসেন বহু মানুষ।
দুপুরের পর থেকে হাজারো মানুষের ভিড় লক্ষাধিক জনসমাগমে রূপান্তরিত হয়।প্রশাসনের পক্ষ থেকেও নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে মেলাচত্বরকে সিসিটিভি ক্যামেরায় মুড়ে ফেলা হয়েছে।
মোতায়েন করা হয়েছে প্রচুর পুলিশ ও সিভিক ভলেন্টিয়ার।আলু আর হলুদ দৃষ্টিনন্দন সর্ষেখেতের সরু আলপথ বেয়ে রঙচঙে অগণিত পিঁপড়ের চলমান সারি আর অসংখ্য কালো মাথা।
পূর্বে বহু দূরদূরান্ত থেকে মানুষ হাঁটাপথেই মেলায় ভিড় জমাতেন।চল ছিলনা যানবাহনের।তাই,দূরদূরান্ত থেকে মানুষ মেলায় এসে আলুরদম ও মুড়ি খেতেন।
বিজ্ঞানের এই যুগে জীবন গতিময় হলেও বিন্দুমাত্র ছেদ পড়েনি এই মেলার প্রাচীন ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিতে।
ক্যানিং থেকে কাঁকড়ার পসরা সাজিয়ে এসেছেন বাসুদেব সরকার।তাঁর কথায়,তাঁর পূর্বপুরুষরাও এই মেলায় সামুদ্রিক কাঁকড়ার পসরা সাজিয়ে আসতেন।
তিনিও এই মেলায় প্রায় ১৫ বছর আসছেন। একপ্রান্তে যখন কাঁকড়া, শুটকি,পোনার আনাগোনা তখন মেলার অন্যপ্রান্তে মাটির উনুনে উপর মাটির পাত্রে আলুর দম তৈরিতে ব্যস্ত সত্তরোর্ধ্ব আনিসুর চাচা।
পাশেই কলাপাতায় আলুরদম,মুড়ি খেতে ব্যস্ত আট থেকে আশি।আনিসুর চাচার মতোই আলুরদম নিয়ে মেলায় বসেছেন বহু মানুষ। আনিসুর হক জানালেন,আলুর দাম চড়া থাকায় কেজি প্রতি আলুরদম এবার ৫০ টাকায় বিক্রি করছেন।
জিলিপি-ঘুগনি-চরকা-বেলুন-খেলনা-ভেঁপু-নাগরদোলা-ধামা-কুলো-বঁটি-কাঠারি সবই রয়েছে এই গ্রামীণ মেলায়।আমতা থেকে মেলায় এসেছেন মানস পাল। মানসের কথায়,এই মেলায় প্রথম আসা তার।
তবে প্রথম দেখাতেই তার মন করে নিয়েছে অনন্য সংস্কৃতির এই মেলা। মেলা মানে সম্প্রীতির পবিত্র অঙ্গন।তেমনই ভাই খাঁ’এর এই মেলাও জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে লক্ষাধিক মানুষের সমাগমে কলকাকলিমুখর হয়ে ওঠে।ভাই খাঁ পীরের মাজারে রয়েছে তাঁর দুই শিষ্যের মাজারও।
সইফ আলি খাঁ এবং গোপাল খা।প্রথম জন মুসলিম,অন্য জন হিন্দু।আর এভাবেই বছরের পর বছর ভাই খাঁ’য়ের স্মৃতি বিজড়িত এই বিখ্যাত মেলা সমাজের কাছে রেখে যায় সম্প্রীতি-সংহতি-সৌহার্দ্যের এক শুভবার্তা।