নিজস্ব সংবাদদাতা : পায়েল, জুলেখা, জবা, মেহেবুবাদের এখন নিঃশ্বাস ফেলার সময় নেই।কেউ ব্যস্ত বোর্ড কাটতে আবার অন্যজন ব্যস্ত কাগজ কাটিংয়ে।ওদের প্রত্যেকেই প্রায় উঠে আসছে নিম্নবিত্ত গ্রামীণ পরিবার থেকে।অন্যদিকে,সারাবছর ঠিকমতো পড়াশোনা করে না।তাই বছর শেষে ওদের মার্কশিটের নাম্বারের ঘরটাও অনেকটা ফাঁকা থেকে যায়।
সায়না,শিউলিদের মতো এমনই বেশ কিছু প্রান্তিক পড়ুয়াদের মধ্যে সুপ্ত থাকা প্রতিভার অন্বেষণ ঘটাতে ও তাদের মধ্যে বিজ্ঞান প্রীতি গড়ে তুলতে বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছে আমতা-১ ব্লকের সোনামুই কাদম্বিনী উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়।অন্যান্য বছরের মতো এবারও বিদ্যালয়ের বার্ষিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে বিজ্ঞান প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছে।তবে এবার একটু অন্যভাবনায় বিজ্ঞান প্রদর্শনীর আয়োজন করেছে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
এবারের প্রদর্শনীর জন্য প্রয়োজনীয় বিভিন্ন মডেল তৈরির দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছে আমিনা,সুহানা,কোয়েল,মেহেবুবার মতো পিছিয়ে পড়া ছাত্রীরা। ক্লাসে ফাঁকি দিলেও হাতে হাত মিলিয়ে অত্যন্ত একাগ্রতার সাথে বিভিন্ন মডেল তৈরিতে ব্যস্ত তারা।তাদের সাথে হাতে হাত লাগিয়ে মডেল তৈরিতে সহায়তা করছেন বিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞানের শিক্ষিকা মধুশ্রী কুমার ও পদার্থবিদ্যার শিক্ষিকা নীলিমা বর।মধুশ্রী কুমার জানান,একদিকে এই সমস্ত প্রান্তিক পড়ুয়াদের মধ্যে সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ ও অন্যদিকে এদের মধ্যে পরিবেশ সচেতনতা গড়ে তোলার লক্ষ্যে একাধিক পরিবেশ বিষয়ক মডেল বানানো হচ্ছে।
প্রায় একমাস ধরে বিভিন্ন মডেল তৈরির প্রস্তুতি চলছে। একাদশ শ্রেণীর ছাত্রীরা তৈরি করছে ‘Save Nature,Save Earth’ নামক একটি বিশেষ মডেল।তার সাথে তুলে ধরা হচ্ছে পরিবেশ সুরক্ষা,জলজ বাস্তুতন্ত্র ও সোলার ইরিগেশন মডেলের মতো অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক কিছু বিষয়কে।অন্যদিকে,সোনামুই গ্রামে বাস বাড়ুই সম্প্রদায়ের।বাড়ুইদের মূল পেশা পান চাষ।তাই পান চাষকেও মডেলের মধ্যে দিয়ে উপস্থাপন করছে ছাত্রীরা।শিউলি,জবারা মাটি দিয়ে তৈরি করছে পান বরুজের মডেল।নবম শ্রেণীর ছাত্রী শিউলি পাঁজার কথায়,তাদের পানের বরজ আছে।
তাই মধুশ্রী ম্যাডামকে প্রথম বরজ তৈরির কথা জানায়।ম্যাডামের পরামর্শে বন্ধুদের নিয়ে শিউলি সেই কাজে এখন ব্যস্ত।জুলেখা,সাইনারা সুনির্মল পরিবেশের বার্তা দিতে তৈরি করছে নির্মল বিদ্যালয়ের মডেল।শিক্ষিকা মৌমিতা পাল সাউ বলেন,”অংশগ্রহণকারী ছাত্রীদের মধ্যেও এবিষয়ে প্রবল আগ্রহ।বিজ্ঞান মডেল তৈরি ছাড়াও বিদ্যালয়ের বার্ষিক পত্রিকাতেও তারা তাদের বিভিন্ন লেখা দিয়ে এগিয়ে এসেছে”।পাশাপাশি,পেঁচা,মাছরাঙা,টিয়ার মতো গ্রাম বাংলার বুক থেকে হারিয়ে যেতে বসা বিভিন্ন পাখিকেও তুলে ধরছে পড়ুয়ারা।
এছাড়াও থাকছে গ্রিন হাউজ এফেক্ট,ডেঙ্গুর কারণ,জলের পুর্নব্যবহার সম্পর্কিত বিভিন্ন জনসচেতনতামূলক মডেল।বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা বন্দনা পাঁজা জানান,’বিদ্যালয়ের ৬৪ তম বার্ষিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে আগামী ৭ ই ফেব্রুয়ারী এই বিজ্ঞান প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছে।এবার মডেল তৈরির কাজে বেশিরভাগ পিছিয়ে পড়া পড়ুয়াদের কাজে যুক্ত করা হয়েছে।”তিনি আরও বলেন,বিদ্যালয়ের বর্তমান ছাত্রীসংখ্যা প্রায় ৬০০।তবে তাদের অধিকাংশই নিম্নবিত্ত পরিবার থেকে অত্যন্ত লড়াই করে উঠে আসছে।
বিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে শিক্ষার ব্যাপারে তাদের সবরকম সহযোগিতা করা হয়।’ভূশণ্ডির মাঠ’ নাটকেও অংশ নিচ্ছে পিছিয়ে পড়া পড়ুয়ারা।নবম শ্রেণীর জুলেখা খাতুনের কথায়,”হাতেকলমে এই কাজ তাদের বিজ্ঞান পড়ায় অনুপ্রেরণা জোগাবে”।আবার কোয়েল পাঁজা জানায়,”সেভাবে বিজ্ঞান পড়তে ভালো না লাগলেও,মডেল তৈরির ফলে সেই বিষয়গুলিকে খুব ভালো করে জেনে যাওয়া যাচ্ছে।
“অষ্টম শ্রেণীর দিশা মাইতির বলে,সে অত্যন্ত আনন্দিত এই মডেল তৈরিতে অংশ নিতে পেরে।বিদ্যালয়ের এহেন উদ্যোগকে একবাক্যে স্বাগত জানিয়েছেন অভিভাবকরাও।অভিভাবিকা মৌসুমি মল্লিক বলেন,বিদ্যালয়ের উন্নতি কেবল একটি শ্রেণীর পড়ুয়াদের উপর নির্ভরশীল নয়।সমস্ত পড়ুয়াকে হাতেকলমে বিজ্ঞানের এই পাঠ সত্যিই বিদ্যালয়ের উন্নতির স্বার্থে অত্যন্ত সহায়ক।আর তাই আরমিনা,জয়শ্রী,মধুমিতার মতো পড়ুয়ারা এখন জোরকদমে প্রস্তুতি নিচ্ছে বিজ্ঞান প্রদর্শনী দেখতে আসা অসংখ্য মানুষের কাছে নিজেদের প্রতিভাকে তুলে ধরতে।