নিজস্ব সংবাদদাতা : এমনিতেই সংসারে নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। তার উপর স্ত্রী’র চিকিৎসার বিপুল খরচ। তবুও আশার আলো দেখতে স্ত্রী’কে নিয়ে মুম্বাই গিয়েছিলেন গ্রামীণ হাওড়ার আমতা-২ ব্লকের দক্ষিণ খালনা গ্রামের বাসিন্দা বলাই রায়। অন্ধকারের মাঝেও আশার আলো জুগিয়েছিল মুম্বাইয়ের বেসরকারি হাসাপাতালের চিকিৎসা। কিন্তু, হঠাৎই বাধ সাধল লকডাউন। লকডাউনের জেরে দীর্ঘদিন ধরে মুম্বাইয়ে আটকে পড়েছেন গ্রামীণ হাওড়ার এই দম্পতি। দীর্ঘ লকডাউনে ফুরিয়েছে খাদ্যরসদ। হাতে কানাকড়ি অর্থও নেই।
যার জেরে বাকি পড়েছে হোটেল ভাড়া। স্থানীয় একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের দেওয়া খাবার খেয়েই কোনোরকমে দিনযাপন করছেন বাণিজ্যনগরীতে আটকে থাকা এই দম্পতি। সূত্রের খবর, গত ২০১৮ সালের জুন মাসে আমতা-২ ব্লকের দক্ষিণ খালনা গ্রামের বাসিন্দা নমিতা রায়ের ক্যান্সার ধরা পড়ে। তারপর থেকে মুম্বাইয়ের একটি বেসরকারি হাসপাতালে স্ত্রী’র চিকিৎসা করাচ্ছিলেন বলাই। ক্যান্সারে আক্রান্ত নমিতাকে বাইশটা কেমোথেরাপি নেওয়ার কথা বলেছিলেন চিকিৎসকেরা। এখনো তাঁর পাঁচটি কেমোথেরাপি নেওয়া বাকি রয়েছে।
কিন্তু, করোনা সংক্রমণের জেরে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে আপাতত বন্ধ থাকবে কেমোথেরাপি ইউনিট। আর তাতেই মহা সমস্যায় পড়েছেন এই দম্পতি। তাই ভাড়া নেওয়া রুমে বসেই কার্যত অর্ধাহারে কোনোরকমে দিন কাটছে তাঁদের। মুম্বাই থেকে ফোনে বিধ্বস্ত কন্ঠে বলাই রায় বলেন, “সতেরোটা কেমোর পরই নমিতার মাথার সব চুল উঠে গেছে। পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ায় জেরে পা ফুলেছে। চিকিৎসকেরা দুধ, ছানা, ফলের মতো পুষ্টিকর খাবার খাওয়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন। কিন্তু, যখন একমুঠো ভাত জুটছে না তখন কীভাবে আর ফল খাওয়াই!”
তিনি আরও বলেন, “লজ মালিকের কাছে বাড়িভাড়া বাবদ প্রায় ১৫ হাজার টাকা বাকি থাকলেও তিনি আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। এই সংকটে তিনি আমাদের বেশ কিছু টাকা ঋণ দিয়েছেন। সেই পয়সাতেই স্ত্রীর জন্য দুধ কিনেছিলাম। কিন্তু এভাবে আর ক’দিনই বা তাঁর কাছে হাত পাতব।” উল্লেখ্য, গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে ক্যান্সার আক্রান্ত স্ত্রীকে নিয়ে চিকিৎসার জন্য মুম্বাই গিয়েছিলেন। সেই থেকে সেখানেই রয়েছেন এই দম্পতি। ফেব্রুয়ারী মাসে মুম্বাইয়ের ওই বেসরকারি হাসপাতালে প্রায় দেড় লক্ষ টাকা ব্যয়ে সার্জারি হয়।
প্রতি সপ্তাহেই কেমোথেরাপি চলছিল। যার খরচ প্রায় ১ লক্ষ ৮০ হাজার টাকা। এতোদিনে কেমো নেওয়া হয়ে যেত। কিন্তু, করোনার জেরে স্তব্ধ হয়েছে সমস্তকিছু। জয়পুর থানার দক্ষিন খালনার বাসিন্দা বলাই রায় আগে একটি বেসরকারি সংস্থায় কাজ করতেন। স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য বিঘা খানেক জমিও বিক্রি করেছেন। এখন সম্বল বলতে সামান্য কিছুটা চাষের জমি। চাষবাসের উপর ভরসা করেই কোনোরকমে দিনগুজরান হয়। পরিবার বলতে দুই ছেলে ও বৃদ্ধ বাবা-মা।
বলাই জানান, “২০১৮ স্ত্রীর ফুসফুসে ক্যান্সার ধরা পড়লে চিকিৎসার জন্য একটি বেসরকারি ঋনদানকারী সংস্থার কাছ থেকে এক লক্ষ টাকা ধার নিই। আমার ভাইও বেশ কিছুটা সাহায্য করে। কোনো রকমে টাকা পয়সা জোগাড় করে মুম্বই আসি স্ত্রী’কে নিয়ে। ওর চিকিৎসা করাতে গিয়ে সব টাকা শেষ। একেবারে নিঃস্ব। হাতে একটা টাকাও নেই। বাড়িতে ফোন করে ভাইকে সব বলেছি। কিন্তু, লক ডাউনের জন্য ভাইও কর্মহীন। তাই ও নিরুপায়।”
হাওড়ার লক্ষীগ্রাম খালনার বাড়িতে বসে বলাই রায়ের ভাই সুব্রত রায় জানান, “বৌদির চিকিৎসার জন্য রাষ্ট্রপতি থেকে শুরু করে প্রধানমন্ত্রী, রাজ্যপাল, মুখ্যমন্ত্রীর কাছে আর্থিক সাহায্যের জন্য আবেদন করা হয়েছিল। মুখ্যমন্ত্রী দপ্তর থেকে একমাত্র ২৪ হাজার টাকা এককালীন সাহায্য পাওয়া গিয়েছিল। এমনকি অর্থের জন্য কলেজে পাঠরত এক ভাইপোর পড়াশোনাও বন্ধ হয়েছে।” সুব্রত বলেন, “লকডাউনের কারনে আমাদের দীর্ঘদিন কাজ বন্ধ। কোনোরকমে সংসার চলছে। মুম্বইয়ে আটকে থাকা দাদা – বৌদিকে এখান থেকে কীভাবে সাহায্য করবো তার কূলকিনারা খুঁজে পাচ্ছি না।” অন্ধকারের পরই আসে ভোর। তাই, লকডাউন কাটলে প্রশাসন ও সরকারের সাহায্যে ঘরের লক্ষ্মীকে নিয়ে লক্ষীগ্রামে ফিরবেন – সেই আশাতেই দিন গুণছেন গ্রামীণ হাওড়ার এই প্রৌঢ়।