নিজস্ব প্রতিবেদক : নরেন্দ্রনাথ দত্তরা ছিলেন অনেক ভাইবোন। তারই মধ্যে স্বামীজির জ্যেষ্ঠা ভগিনীর নাম ছিল হারামণি। জন্ম ১৮৫৮ সালে। সম্ভবত, দুই সন্তানের অকাল মৃত্যুজনিত কারণেই এই নাম রেখেছিলেন বিশ্বনাথ দত্ত। হারামণি শৈশবে কোলকাতার বেথুন কলেজিয়েট স্কুলের ছাত্রী ছিলেন। এমনকি সূচীশিল্পেও বিশেষ পারদর্শী ছিলেন বলে জানা যায়। তবে তৎকালীন সমাজে প্রচলিত বাল্যবিবাহের হাত থেকে রক্ষা পাননি স্বামীজির ভগিনী হারামণিও। মাত্র দশ বছর বয়স থেকেই পিতা সুপাত্রের খোঁজ শুরু করেন।
এভাবেই তিনি খোঁজ পান হাওড়ার আমতার খড়িয়পের জমিদার সূর্যকুমার বসুর সুপুত্র মাখনগোপাল বসুর। মাখনগোপাল সুপুরুষ, সুদর্শন, সুউপায়ী ও কোলকাতার এক সওদাগরি অফিসে কর্মরত। দুই পরিবারের সহমতে ১৮৬৮ সালে মাখনগোপাল ও হারামণির বিয়ে হয়। মাত্র দশ বছর বয়সে বিশ্ববরেণ্য বীর সন্ন্যাসীর ভগিনী আমতার কাছে খড়িয়প গ্রামের জমিদার বসু পরিবারের বধূ হয়ে এলেন।
প্রাথমিকলগ্নে হারামণি দেবীর জীবন খুব সুখে স্বাচ্ছন্দ্যে কাটছিল। ১৭ বছর বয়সে তিনি জন্মদিলেন এক কন্যা সন্তানের। নাম রাখলেন শিবকালী। কন্যাসন্তানের জন্ম দেওয়ায় তিনি ক্রমশ বসু পরিবারের অপ্রিয় পাত্রী হয়ে উঠলেন।মাখনগোপাল ও হারামণির দাম্পত্যজীবনে ক্রমশ দুঃখের আঁধার ঘনিয়ে এলো। মাখনগোপাল ক্রমশ মুখ ফেরাতে থাকলেন তার প্রিয়ার দিক থেকে।
অন্যদিকে, মাখনগোপাল কর্মসূত্রে প্রায়শই কোলকাতায় শিমলার শ্বশুরবাড়িতে যেতেন। বিশ্বনাথের জ্ঞাতিভাই তারকনাথ দত্তের তৃতীয় কণ্যা হরসুন্দরীর রূপে, গুণে তিনি কার্যত মুগ্ধ হয়ে পড়েন। তিনি হরসুন্দরীকে বিয়ের প্রস্তাব দেন। কিন্তু, এই প্রস্তাবে তারা প্রথমে রাজি না হলেও তারকনাথ বাবু ও ওনার স্ত্রী জ্ঞানদাসুন্দরী দেবী কোনোভাবেই অখুশি ছিলেন না। এই খবর যখন হারামণি দেবী জানতে পারলেন তখন তিনি এর তীব্র প্রতিবাদ জানান। এরপরেই তাদের মধ্যে প্রবল মোনোমালিন্যের সৃষ্টি হয়। এরই কয়েকদিন পর ১৮৮০ সালে একদিন সন্ধ্যায় তিনি কলকে নামক বিষাক্ত ফল খেয়ে ‘আত্মহত্যা’ করেন।
তবে আরেকটি সূত্র অনুসারে জানা যাচ্ছে, হারামণি দেবীকে শ্বাসরোধ করে খুন করা হয়েছিল ও তার দেহকে বসু পরিবারের নাচঘরের বাগানের কোনো স্থানে কবরস্থ করা হয়। হারামণি দেবীর মৃত্যসংবাদ পেয়ে দু’দিন পর আমতার মাটিতে পা রাখলেন বিশ্ব ভাতৃত্বের মূর্ত প্রতীক, চিরপ্রণম্য বিশ্ববরেণ্য ভুবনজয়ী মহামানব বীরসন্ন্যাসী পুরুষোত্তম ‘স্বামী বিবেকানন্দ’। সালটা ছিল ১৮৮০। তিনি ভাগ্নী তথা ৫ বছরের শিবকালীকে নিয়ে কোলকাতায় ফেরেন।বিশেষভাবে উল্লেখ্য, স্বামীজি জীবনে খুব কমই দুঃখ পেয়েছিলেন। তারমধ্যে হারামণি দেবীর মৃত্যুতে তিনি অত্যন্ত দুঃখ পান।
পরবর্তীকালে সরকারি হস্তক্ষেপে জমিদারী প্রথা লোপ পেলে বসু পরিবার এই বেড় বাগানবাড়ি, নাচঘর,’রামকৃষ্ণ মিশন’-কে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু ‘রামকৃষ্ণ মিশন’ বিশেষ আগ্রহ প্রকাশ না করায় এখানে ১৯৯৫ সালে গড়ে ওঠে ‘শ্রী রামকৃষ্ণ প্রেমবিহার আশ্রম’।বর্তমানে সেখানে বিদ্যালয়-পাঠাগার-মন্দির গড়ে উঠেছে।স্বামীজির পাদস্পর্শ্যধন্য এই স্থান যে কত পবিত্র তা হারামণি দেবীর মৃত্যুর শতবর্ষ পরেও ‘শ্রীরামকৃষ্ণ প্রেমবিহার স্থাপন’-এর মধ্যদিয়ে উপলব্ধ।