পৃথ্বীশরাজ কুন্তী : করোনার জেরে দীর্ঘদিন সেভাবে কোথাও বেড়াতে যাওয়া হয়ে ওঠেনি। লকডাউন পিরিয়ডে সংগঠনের কাজে সুন্দরবন ও পাশ্ববর্তী জেলার বেশ কয়েকটি জায়গায় দু-একবার গেলেও সেই অর্থে ভ্রমণে যাওয়ার সুযোগ হয়নি। তাই ভ্রমণপিপাসু মন বারে বারে ব্যাকুল হয়ে উঠছিল। তাই একপ্রকার বাধ্য হয়েই দু’দিনের ছুটিতে বেড়িয়ে পড়লাম। এবারের ট্যুরটা একটু ভিন্ন। জীবনের প্রথম বাইক ট্যুর। চারটে বাইকে আটজন। একপ্রকার হঠাৎ করেই বেড়িয়ে পড়া।
এবারের গন্তব্য বাংলার সীমান্তবর্তী এলাকা বেলপাহাড়ি। কিন্তু, সংশ্লিষ্ট এলাকা সম্পর্কে সেভাবে কোনো কিছুই জানা ছিলনা। ফেসবুক ঘাঁটতে গিয়েই পেলাম বিধানবাবুর নাম্বার। উল্লেখ্য, বিধানবাবুও একজন ভ্রমণপিয়াসী। ভ্রমণের নেশা থেকেই একপ্রকার জঙ্গলমহল চষে বেড়িয়েছেন। জঙ্গলমহলের বিভিন্ন এলাকা সম্পর্কে তাঁর বিস্তর জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা। একেই বলে কপাল যোগ। দু’জন কেউ কাউকে চিনিনা-জানিনা। কিন্তু, প্রথম দিনের ফোনালাপেই উনি যেভাবে আন্তরিকতার সাথে আমায় আশ্বস্ত করলেন তাতে ভরসা রেখেই এক শীতের ভোরে বেড়িয়েই পড়লাম।
বরাবরই অফবিট ডেস্টিনেশন আমার পছন্দের তালিকায় সর্বাগ্রে স্থান পায়। তাই বিধানবাবুর কাছে অফবিট বেলপাহাড়ি ঘুরে দেখার ইচ্ছেপ্রকাশ করলাম। সেই মোতাবেক উনি আমাদের রুট বানিয়ে দিলেন। সেই রুট ধরেই দু’দিনের এক অভূতপূর্ব বেলপাহাড়ি ভ্রমণের সাক্ষী থাকলাম। দীর্ঘ রাতের অবসান ঘটিয়ে সূর্য যখন উদয়ের পথে তখন ফাঁকা হাইওয়েতে আমাদের বাইক নিজের ছন্দে ছুটে চলেছে। মাঝে দু-একবার চা পানের বিরতি। খড়গপুরের পর থেকেই মাটির রঙ পরিবর্তন চোখে পড়তে শুরু করেছে। সাথে রাস্তার দু-পাশে শালের জঙ্গল। পথে দেখে নিলাম ঝাড়গ্রাম শহরের অদূরে থাকা চিল্কিগড়ের কনকদূর্গা মন্দির, কনক অরণ্য। চিল্কিগড়ের প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী দুর্গ এবং রাজবাড়িও দেখলাম। ঘড়ির কাঁটায় যখন বেলা সাড়ে এগারোটো তখন পৌঁছে গেলাম বেলপাহাড়ির বুকে। দু’দিনের ঝটিকে সফরে গেছি। তাই বিশ্রামের কোনো প্রশ্নই হয়না। ইন্দিরাচকের হোটেলে ব্যাগ রেখে বিধানবাবুর বানিয়ে দেওয়া রুটম্যাপের কাগজ আর গুগল ম্যাপকে সঙ্গী করে আমরা বেড়িয়ে পড়লাম।
বেলপাহাড়ির ট্যুরিজম মানেই কাঁকড়াঝোড়, ময়ূরঝর্ণা, ঘাগরা, লালজল, গড়রাসিনী পাহাড়?— না, এর বাইরেও বেলপাহাড়ির অদূরেই অবস্থান করছে বহু গ্রাম, বহু স্থান। যাদের প্রাকৃতিক শোভা ভাষায় ব্যক্ত করাটা সত্যিই কঠিন। আর সেরকম জায়গাগুলিকেই আমাদের তালিকায় প্রাধান্য দিয়েছিলেন বিধান বাবু। শাল-মহুয়া-কেন্দুর জঙ্গল আর রাঙামাটির আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ পেরিয়ে দেখলাম আগুইবিল হাট। এখানকার হাট স্থানীয় সংস্কৃতির অন্যতম নিদর্শন বলা যায়। রবিবার বিকালে পাহাড়ের কোলে আগুইবিলে হাট বসে। আশপাশের বেশ কয়েকটি গ্রাম থেকে মানুষ এখানে আসেন। আর পাঁচটা পাহাড়ি হাটের মতোই এই হাটেরও আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে মুরগির লড়াই। আগুইবিল হাট দেখে আমাদের বাইক পাহাড়ের উঁচুনিচু নির্জন পথধরে এগিয়ে চললো। পথে পড়ল আমরোলা, হরিণারায়ণপুর, ব্যাঙগোটা, ডাঙরডিহা, বিরগি, নুনঢালা। নাহ, এগুলি কোনো তথাকথিত ট্যুরিস্ট স্পট নয়। সচরাচর পর্যটকরাও এখানে পা মাড়াননা। ওই আমাদের মতো গুটিকয়েক পর্যটক মাঝেমধ্যে আসেন।
এই সমস্ত প্রত্যন্ত আদিবাসী গ্রামগুলি ঘুরে আদিবাসী সংস্কৃতি, এখানকার মানুষের সার্বিক জীবনযাত্রা সম্পর্কে জানলাম। মাটির বাড়িতে বিভিন্ন শিল্পকলার নিদর্শন দেখলাম। আর গ্রামের প্রান্ত থেকে দাঁড়িয়ে দূরে থাকা সবুজে ঢাকা পাহাড়ের সারির অদ্ভুত সৌন্দর্যকে উপভোগ করলাম। যখন ময়ূরঝর্ণায় গিয়ে পৌঁছলাম তখন সন্ধ্যে নামতে শুরু করেছে। তাই ট্রেক করে আর ঝর্ণা দেখতে যাওয়া হলনা। পাহাড়ের কোলঘেঁষা দুটি গ্রাম বাগডোবা আর চাকডোবার মধ্য দিয়ে ইন্দিরাচকের হোটেলের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। আর এই পাহাড়ি পথেই দিনের শেষে পাহাড়ের কোলে সূর্য ঢলে পড়ার অসম্ভব সুন্দর মুহুর্তের সাক্ষী থাকলাম। জনবসতিহীন জঙ্গলের মধ্য দিয়ে অনেকটা পাহাড়ি পথ পেরোতে হবে। তাই চলন্ত বাইকে বসেই সেই সৌন্দর্যকে উপভোগ করতে হল। দিনটি রাসপূর্ণিমার আগের দিন হওয়ায় চারিদিক জুড়ে অদ্ভুত নিস্তব্ধতাকে ভেদ করে চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছিল সামনে থাকা পাহাড়ের সারিগুলি। এযেন একটুকরো মায়াবী স্বপ্নপুরীর রূপকথার গল্প।
এই নয়নাভিরাম মুহুর্ত গুলিকে ক্যামেরায় বন্দী করা কিমবা ভাষায় ব্যক্ত করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তাই দুচোখ ভরে উপভোগ করতে করতেই সেদিনের মতো হোটেলে ফিরে এলাম। পরের দিন খুব সকালেই বেড়িয়ে পড়লাম। এদিন আমাদের সাথে বিধান বাবু নিজেই বাইক নিয়ে বেড়িয়ে পড়লেন। অবশ্য উনি আমাদের সাথে না বেরোলে আমাদের এদিনের যাত্রাটা বোধহয় অসম্পূর্ণই থেকে যেতে। কারণ, সেদিনের তালিকায় বেলপাহাড়ি সংলগ্ন এমন বেশ কিছু জায়গা ছিল যেখানে গত ৮-১০ বছরে হাতেগোনা গুটিকয়েক পর্যটক পা মারিয়েছেন বলে বিধানবাবু জানালেন। তাই রাস্তা খুঁজে পাওয়াটাও বেশ কষ্টসাধ্য। সামনে বিধানবাবু। আর তাঁর দেখানো চড়াই-উতরাই পাহাড়ি পথে এগিয়ে চলেছে আমাদের চারটি বাইক।
লালমাটির পথ কখনো বা সরু মাঠের আল ধরে এগিয়ে চলা। কিছুটা এগিয়ে গিয়েই মূল রাস্তা ছেড়ে ঢুকে পড়লাম ঝোপাঝাড়ের রাস্তায়। সেই রাস্তা ধরে কিছুটা এগোতেই চোখের সামনে ভেসে উঠল রৌদ্রস্নাত সাদা পাথর। কেন্দাপাড়া গ্রামের হাঁসাডুংরি। পাহাড়টি শ্বেত পাথরের। যদিও দীর্ঘদিন ধরে পাথর কেটে নেওয়ায় পাহাড়ের সিংহভাগই বর্তমানে ক্ষয়ে গেছে। তবুও যেটুকু অবশিষ্ট রয়েছে তার শীর্ষে উঠে আশপাশে থাকা পাহাড়, আর সবুজ জঙ্গলকে প্রত্যক্ষ করলাম। আবার সামনের দিকে এগিয়ে চলা। কিছুটা জঙ্গলাকীর্ণ পথের মধ্য দিয়ে গিয়ে বেলপাহাড়ি ও চাকুলিয়া সীমানায় অবস্থিত কানাইসোর পাহাড়ের অপরূপ রূপকে দেখলাম। ঝাড়গ্রাম জেলার অন্যতম উচ্চতম এই পাহাড়ে। উল্লেখ্য, প্রতিবছর আষাঢ় মাসের তৃতীয় শনিবারে বেলপাহাড়ি ও ঝাড়খন্ড সীমানা লাগোয়া বেশ কয়েকটি গ্রামের মানুষ কানাইসোর পাহাড়কে দেবজ্ঞানে পুজো করেন। এই পাহাড়ের পুজোর দায়িত্ব আদিবাসী মাল সম্প্রদায়ের উপর থাকে।
পাহাড়ের উপরে ছাগ বলি, নীচে মুরগিবলি দেওয়া হয়। পাহাড়জুড়ে বসে মেলা। এসব অজানা কাহিনীকে জানতেই তো বারেবারে ছুটে যাই ‘অফবিট’ জায়গায়। যাইহোক হাতে সময় খুব কম। তাই কানাইসোরকে মুঠোফোনের ক্যামেরায় বন্দী করে ঢাকাই, পচাপানি হয়ে পাশ্ববর্তী রাজ্য ঝাড়খন্ডের মধুপুরে প্রবেশ করলাম। সেখান থেকে আবার বাংলার জোবি গ্রাম। জোবি থেকে জরমা, লবণী হয়ে এলাম শিমুলপালে। পথে মাঝেমধ্যে দু-একটি আদিবাসী জনবসতি। পথের বাঁক থেকে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা পাহাড়ের অনন্যসাধারণ দৃশ্যগুলো কিমবা পাহাড়ের কোলের একটুকরো সমতল ভূমিতে ফলের গাছে স্থানীয় খুদেদের ফল পাড়ার সেই মুহুর্তগুলো এখনো চোখের সামনে ভেসে উঠছে। পথের ধারে কখনো দেখা মিলছে সুন্দরী ময়ূরীর আবার কখনো বা বুনো হাঁসের। এসব দৃশ্য আর চারপাশের অপরূপ প্রাকৃতিক শোভাকে উপভোগ করতে করতেই পবন পাহাড়ের (স্থানীয় নাম চিতি পাহাড়) পাদদেশে এসে হাজির হলাম। বেশ কিছুটা ঘাসের জঙ্গল পেরিয়ে পাহাড়ে ওঠার সংকীর্ণ পথ। তা অনুসরণ করেই সাবধানে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২০১ মিটার উচ্চতাবিশিষ্ট পবন পাহাড়ের উপর উঠে পড়লাম।
পবন পাহাড়কে বেলপাহাড়ীর ‘রক গার্ডেন’ বলা যেতেই পারে। পবন পাহাড়ের উপর থেকে চারিদিকের দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ উপত্যকা, আর দূরে থাকা নাম না জানা অসংখ্য পাহাড়-গ্রামের অপরূপ প্রাকৃতিক শোভার ৩৬০ ডিগ্রি ভিউ। এককথায় বর্ণনাতীত। পবন পাহাড়ের নীচেই বাস পবন শবর ও তাঁর পরিবারের। পবন শবরই এই পাহাড়টিতে পুজো করেন। তাই তাঁর নামানুসারেই গত ৩-৪ বছর আগে পবন পাহাড়ের নামকরণ করা হয়েছে বলে জানতে পারলাম। পবন পাহাড় থেকে নেমে আমাদের গন্তব্যস্থল লাট্টু পাহাড়। খুব একটা উঁচু না হলেও লাট্টু পাহাড়ের মাথা থেকে চারপাশের ৩৬০° ভিউ পাওয়া যায়। লাট্টু পাহাড়ের মাথায় দাঁড়িয়ে কানাইসোর পাহাড়, গজডুংরি, চাতন ডুংরি, চিতি পাহাড়, হাঁসাডুঙরি, গড়রাসিনি পাহাড়, ঠাকুরানপাহাড়ী সহ চারপাশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য খুব সহজেই উপভোগ করা যায়। লাট্টু পাহাড়ের মাথা চ্যাপ্টা হওয়ার জেরে অ্যাডভেঞ্চার পিপাসুরা এখানে তাঁবু খাটিয়ে রাত্রিযাপন করতে পারেন। যদিও আমাদের বাড়ি ফেরার তারা থাকায় দ্রুত হোটেলে ফিরতে হল।
বেলপাহাড়ি মানে কেবল হাতেগোনা কয়েকটা ভিউ পয়েন্ট, লেক কিমবা ঝর্ণা নয়; প্রাকৃতিক শোভা আর সুপ্রাচীন ইতিহাসের এক অপার মেলবন্ধনের নাম বেলপাহাড়ি। বেলপাহাড়ির বুকে যেমন রয়েছে ডুলুং, তারাফেনী নদী, রয়েছে চাতন, কাঁকড়াঝোড়, লালজল, ঢাঙ্গিকুসুম জলপ্রপাত সহ একাধিক পাহাড়। তেমনই বেলপাহাড়ির অনতিদূরেই অবস্থান করছে ভারতের অন্যতম প্রাচীনতম ‘ঐতিহাসিক’ গ্রাম আস্তাজুড়ি। আবার ভারতে প্রথম তামার তৈরি কুঠার পাওয়া গিয়েছিল বেলপাহাড়ির ভুলাভেদা অঞ্চলের তামাজুড়ি নামক গ্রাম থেকেই। এছাড়াও গড়রাসিনী পাহাড়ের পাথরের সুপ্রাচীন গুহাগুলি আজও অজস্র ঐতিহাসিক তথ্য বহন করে চলেছে। তাই যাঁরা প্রকৃত অফবিট পিয়াসী তাঁরা বেলপাহাড়িতে সময় নিয়ে আসুন। ঘুরে দেখুন এই প্রাচীন জনপদের ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতি ও অনির্বচনীয় প্রাকৃতিক শোভাকে। এবার মাত্র দু’দিনের সফর। তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও বেলপাহাড়ির অপরূপ প্রাকৃতিক রূপ, ইতিহাস, লোক-সংস্কৃতি ও সর্বোপরি বিধানবাবুর মতো মানুষকে সাদরে বিদায় জানিয়ে বিনপুর, লালগড়ের জঙ্গল, পিড়াকাঁটা, গড়বেতা, খড়্গপুর হয়ে বাড়ির পথে রওনা দিলাম। অদেখাকে দেখতে, অজানাকে জানতে আবার আসব বেলপাহাড়ির বুকে, কথা দিলাম।