আমতার অমরাগড়ী রায় বাড়িতে ৩০০ বছরের প্রাচীন দুর্গোৎসবকে ঘিরে সাজো সাজো রব, করোনার জেরে বন্ধ সিঁদুরখেলা

By নিজস্ব সংবাদদাতা

Published on:

নিজস্ব প্রতিবেদন : সালটা ১১২৬ বঙ্গাব্দ।তৎকালীন সময়ের প্রথিতযশা বণিক ছিলেন শান্তি রায়। ব্যবসা সূত্রে তিনি প্রায়শই দেশ-বিদেশের বিভিন্ন প্রান্তে পাড়ি দিতেন। তেমনই এক সফরকালে রাত্রিযাপনের জন্য তিনি ঘাঁটি গাড়লেন বর্তমান গ্রামীণ হাওড়ার আমতা-২ ব্লকের অমরাগড়ী গ্রামে।কথিত আছে, শান্তি বাবু সেই রাতেই গজলক্ষী দেবীর স্বপ্নাদেশ পান এবং সেই অনুযায়ী তিনি অমরাগড়ী গ্রামে ‘গজলক্ষী মাতা এস্টেট’ গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেন। ১১২৬ বঙ্গাব্দের ১৫ ই বৈশাখ প্রতিষ্ঠিত হল ‘গজলক্ষী মাতা এস্টেট’। এক আদর্শ গ্রাম গড়ার লক্ষ্যে শান্তি রায় উদ্যোগী হয়ে বাইরে থেকে বিভিন্ন জাতি ও ধর্মের মানুষকে নিয়ে এলেন অমরাগড়ী গ্রামে। ধর্মাচারের পাশাপাশি গ্রামের সার্বিক উন্নয়নে উদ্যোগী হল এই এস্টেট। গজলক্ষী মাতার মন্দিরের পাশাপাশি গড়ে উঠল শিব মন্দির। রায় বাড়িতে চালু হল রথযাত্রা, জন্মাষ্টমী, রাসযাত্রা, শিবরাত্রি, গাজন। এর পাশাপাশি, স্থানীয় মানুষের মনোরঞ্জনের উদ্দেশ্যে চালু হল দুর্গাপুজো। এই সুপ্রাচীন ট্রাস্ট পরিচালিত দুর্গোৎসব গতবছরই ৩০০ বছর পূর্ণ করেছে। এবার পুজোর বয়স ৩০১ বছর। যদিও করোনার জেরে এবার কোনোরকমে এই ঐতিহ্যবাহী দুর্গোৎসব অনুষ্ঠিত হচ্ছে। বাজেটে যেমন কাটছাঁট করা হয়েছে, তেমনই করোনা সম্পর্কিত স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার লক্ষ্যে একাধিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে উদ্যোক্তাদের তরফে।

রায় বাড়ি সূত্রে জানা গেছে, প্রাথমিক লগ্ন থেকে একচালায় নির্মিত চামূন্ডা মূর্তি মহামায়া রূপে এখানে পূজিতা হন। মহালয়ার পরদিন অর্থাৎ প্রতিপদ থেকেই এই বনেদী বাড়ির পুজোয় ঢাকে কাঠি পরে যায়। শুরু হয় চণ্ডীপাঠ, সান্ধ্যকালীন নিত্য আরতি। বাড়ির মহিলারা ব্যস্ত হয়ে যান নাড়ু পাকানোর কাজে। দুর্গাদালানে কচিকাচাদের ভিড় জমতে শুরু করে। যদিও করোনার জেরে এবার প্রায় সবই বন্ধ। ‘গজলক্ষী মাতা এস্টেট’-এর বর্তমান সম্পাদক সৌরভ রায় জানান, “করোনার কথা মাথায় রেখে এবার বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। আমাদের দুর্গাদালানের সামনে একসাথে ৭০-৮০ জন বসতে পারেন। কিন্তু, এবার ১০-১২ জনের বেশি একসাতে বসতে দেওয়া হবে না। গ্রামের বহু মানুষ আমাদের এখানে পুজো দিতে আসেন। এবারও নিশ্চিতভাবে। কিন্তু, তাঁদের পুজোর ডালাকে নিয়ে প্রথম স্যানিটাইজ করা হবে। পাশাপাশি, এবার আর কাটা ফল নয়, পুজোয় ব্যবহৃত হবে গোটা ফল।”

বহু ইতিহাসের সাক্ষ্যবহনকারী এই বাড়ির অন্দরমহলে কান পাতলে কিমবা এস্টেটের ইতিহাসের পাতা ঘাঁটলে এই দুর্গাপুজো সম্পর্কে অনেক অজানা চমকপ্রদ তথ্যই উঠে আসে। পরিবার সূত্রে জানা যায়, পূর্বে মোষবলির প্রচলন থাকলেও তা বহু বছর আগেই বন্ধ হয়েছে। এর পিছনেও রয়েছে এক বিস্ময়কর কাহিনী। শোনা যায়, প্রায় দু’শো বছর আগে এক কামার রায় বাড়ির সন্ধিপুজোর জন্য বাড়ি থেকে রওনা দিয়েছিল। রাস্তায় বাঘের খপ্পরে পরলে সেই কামার বাঘের মুন্ডুচ্ছেদ করে। তারপর থেকে দেবীর স্বপ্নাদেশেই চিরতরে বন্ধ হয়ে যায় মোষবলি প্রথা। মোষবলির এই প্রাচীন প্রথা বন্ধ হলেও চিরাচরিত প্রথা অনুসারেই আজও নবমীর সন্ধ্যায় আগত দর্শনার্থীদের মধ্যে লুচি ভোগ বিতরণ করা হয়। বিজয় দশমীতে বরুণ দেব যখন মধ্যগগনে আসীন তখন ভারাক্রান্ত হৃদয়ে পারিবারিক রথপুকুরে বিসর্জনের পথে এগিয়ে চলেন এই ঐতিহ্যসমৃদ্ধ পরিবারের মৃন্ময়ী মা। রায় বাড়ি সূত্রে জানা যায়, প্রায় দেড়শ বছর আগে পরিবারের এক সদস্য দুপুর ১২ টা’য় মারা যাওয়ার পর থেকেই দেবীর নিরঞ্জন প্রক্রিয়া ঠিক দুপুর ১২ টায় সম্পন্ন হয়। অন্যান্যবার দশমীতে সিঁদুর খেলায় মেতে ওঠেন বাড়ির মা-বোনেরা। কিন্তু, এবার করোনা পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে সিঁদুরখেলাও বন্ধ বলে জানান এস্টেটের সম্পাদক সৌরভ রায়।

আর পাঁচটা প্রাচীন বনেদী বাড়ির দুর্গোৎসবের মতোই কালের নিয়মে হারিয়ে গেছেন স্রষ্টারা, ভাটা পরেছে আড়ম্বর-সাবেকীয়ানায়, লুপ্ত হয়েছে বহু রীতি। করোনার জেরে থমকে বহু আয়োজন। তা সত্ত্বেও তিনশো বছরের প্রাচীন ও ঐতিহ্যমন্ডিত পুজোকে কেন্দ্র করে সাজো সাজো রব অমরাগড়ীর রায় বাড়ি জুড়ে।