নিজস্ব প্রতিনিধি : ২০০৯ থেকে ২০২০ – মাঝে কেটেছে দীর্ঘ একটা দশক। কিন্তু, সুন্দরবন সহ উপকূলবর্তী অঞ্চলের মানুষের চোখে আজও টাটকা ‘আইলা’-র বিধ্বংসী প্রলয়রূপের দুঃসহ স্মৃতি। প্রকৃতি বিরূপ হলে পরিস্থিতি যে কী হতে পারে তা সেদিনের ভুক্তভোগীরা হাড়েহাড়ে টের পেয়েছেন। এমনকি, আজও সুন্দরবনের বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে আয়লার নির্মম স্মৃতি। এরই মধ্যে আবার সুন্দরবনবাসী ফণীর ফণা, বুলবুলের তান্ডব দেখেছে। তারপরই কি আসতে চলেছে ‘আম্ফান’!এখন এই প্রশ্নেই কার্যত ঘুম উড়েছে আতঙ্কিত সুন্দরবনবাসীর৷ সেদিনের ‘আইলা’র বেশে আবার প্রবল বেগে ধেয়ে আসছে না তো ‘আম্ফান’! – এই ভেবেই শঙ্কিত এবং চিন্তিত সুন্দরবনের মানুষজন। ইতিমধ্যেই মানুষজনের মধ্যে শুরু হয়ে গেছে ঘর গোছানোর পালা। স্থানীয় ব্লক প্রশাসনগুলির পক্ষ থেকে বিভিন্ন ব্যবস্থা নেওয়ার নেওয়া হচ্ছে। জারি করা হয়েছে রেড অ্যালার্ট। পঞ্চায়েত কার্যালয়গুলিতে খোলা হয়েছে বিশেষ কন্ট্রোল রুম।
এরকমই একটি ‘আইলা’ বিধ্বস্ত গ্রাম সুন্দরবনের জি-প্লট। নদী ও বঙ্গোপসাগর পরিবেষ্টিত একটি দ্বীপ। নিকটতম শহরতলি বলতে পাথরপ্রতিমা (জলপথে প্রায় ২ ঘন্টা)। ভ্রমণের তাগিদে গত ২০১৮ সালের মে’মাসে গিয়েছিলাম প্রকৃতির অনন্যসুন্দর সম্পদে সমৃদ্ধ এই দ্বীপে। নদী-জঙ্গল-সমুদ্র কী নেই;প্রকৃতির সমস্ত উপাদান মজুত থাকলেও নেই শুধু মানুষের আবেগ। আর থাকবেই বা কেন! ২০০৯ এর ২৫ শে মে’র দগদগে নির্মম স্মৃতি আজও যে দু’চোখের সামনে ভেসে ওঠে। প্রতিবেদন লিখতে গিয়ে আজও মনে পড়ছে আমাদের মোটরভ্যানের চালক রবির কথা। আমাদের দু’দিনের সফরসঙ্গী বছর তিরিশের রবি নির্জন সমুদ্র তীরে দাঁড়িয়ে শুনিয়েছিল সেদিনের হাড়হিম করা দুর্যোগের কাহিনী। আজও আমার কানে ভেসে উঠছে রবির কথাগুলো, “আমি দাঁড়িয়ে দেখলাম, আমাদের বাড়ির সামনেই বিশাল বড়ো পুকুরে জল ঢুকতে শুরু করল।
আমি প্রাণ বাঁচাতে বাড়ির লোকেদের নিয়ে প্রাইমারি ইস্কুলে গিয়ে উঠলাম। সেখান থেকেই দেখছিলাম, আইলায় সমস্ত জিনিসপত্র ভেসে চলে যাচ্ছে। আমার মনে হতে লাগল, আমার ঘরবাড়ি কিছুই বোধহয় আর নেই। তাহলে কোথায় থাকব আমরা?” এশুধু রবির একার কথা নয় সমগ্র জি-প্লট সহ সুন্দরবনবাসীর কথা। সমুদ্রের জল ২০ ফুট উঁচু হয়ে ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল সুন্দরবনের বিস্তীর্ণ নদীবাঁধ। মুহুর্তের মধ্যে অসংখ্য গবাধি পশু, মাটির বাড়ি আইলার গ্রাসে নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল সেদিন। সেদিনের প্রকৃতির দানবীয় তান্ডবে প্রাণ হারিয়েছিলেন বহু মানুষ। সমগ্র দ্বীপ সমুদ্র-নদীর জলে প্লাবিত হয়েছিল। তালগাছ সমান ঢেউ, দ্বীপ জুড়ে কোমরসমান জল। ভেসে গিয়েছিল নোঙর করা অজস্র নৌকা। খাদ্য তো দুরস্ত একফোঁটা পানীয় জলের জন্য হাহাকার লেগেছিল সুন্দরবনের বিভিন্ন প্রত্যন্ত দ্বীপে। এসবই আজও চোখের সামনে ভেসে ওঠে সুন্দরবনের প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষের চোখে।
পড়ন্ত বিকেলের হাওয়া খেতে খেতে গোবর্ধনপুর সৈকতে দাঁড়িয়ে প্রকৃতির অনন্যসাধারণ রূপ ও নির্জন সৈকতকে উপভোগ করতে করতে এইসব কাহিনীই শুনছিলাম। আর দেখছিলাম আইলার তান্ডবে তলিয়ে যাওয়া হাজারো গাছের ধ্বংসাবশেষটুকু। মাইলের পর মাইল সুন্দরী, গরাণ, গেঁওয়া, হেঁতালের কঙ্কাল দেখছিলাম। রাতের খাবার খেতে গিয়েছিলাম ইমাম চাচার হোটেলে। তাঁর কথাগুলো আমার আজও বেশ মনে আছে, “ওই দিনের কুথা মনে হলি আর ব্যাঁচতি ইচ্ছে হয় না৷ এরপর আইলা আমার সবকিছু ক্যাড়ে নে।” কথাগুলো বলেই হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেন ষাটোর্ধ্ব ইমামচাচা৷ সকাল থেকে সন্ধ্যা এভাবেই তাঁদের সেদিনের দগদগে স্মৃতি চোখের সামনে ভেসে ওঠে। চাষযোগ্য জমিতে সমুদ্রের লবণাক্ত জল প্রবেশের ফলে তা অনুর্বর হয়ে গেছে। দশক ঘুরে গেলেও সম্পূর্ণ হয়নি আইলা বাঁধ তৈরির কাজ, কেবল ভাঙা গড়ার খেলা চলছে আর সেই খেলায় সুন্দরবনের মানুষ দিন গুণে চলেছেন।
আইলার পর কোটি টাকার ত্রাণ এসেছিল বৈকি, কিন্তু আদপে সুন্দরবনের ‘আইলা’ বিধ্বস্ত মানুষ কতটা পেয়েছিলেন তা তাঁরাই জানেন। তবুও নিজেদের জীবন-জীবিকাকে পাথেয় করে সরকারি-বেসরকারি সাহায্য নিয়ে তাঁরা ঘুরে দাঁড়ানোর মরিয়া চেষ্টা আজও চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু আইলা আসে, ফাইলিন যায় ফণী ফণা তোলে আবার বা ‘আম্ফান’ তার আস্ফালন দেখাতে আসে। এধরনের প্রাকৃতিক রূদ্ররোষ উপেক্ষা করেই রবি, ইমাম চাচার মতো সুন্দরবনের উপকূলীয় অঞ্চলের অসংখ্য মানুষ জীবন যুদ্ধে বেঁচে থাকেন। এবার ধেয়ে আসছে ‘আম্ফান’। আবহাওয়া দপ্তরের সতর্কবার্তা বলছে, আজ থেকে ঘূর্ণিঝড় উত্তর ও উত্তর পশ্চিম দিকে এগিয়ে যাবে। তারপর উত্তর ও উত্তর পূর্ব দিকে বাঁক নিয়ে ধাবমান হবে উত্তর-পশ্চিম বঙ্গোপসাগর অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গের উপকূলের উপর দিয়ে। আগামী ১৮ থেকে ২০ শে মে’র মধ্যে ‘আম্ফান’-এর আছড়ে পড়ার আশঙ্কা। ন’বছর পরে হলেও দেখেছিলাম ‘আইলা’ নামক ধ্বংসলীলার অবশিষ্টাংশ। তাই বড়ো ভয় হয় যে রবি, ইমামচাচার মতো অসংখ্য উপকূলবাসী লড়াকু মানুষের কথা ভেবে। প্রকৃতির কাছে মানুষ যে নিতান্তই অসহায় শিশু!