নিজস্ব সংবাদদাতা : বছর কুড়ি পঁচিশ আগে পর্যন্ত পূজো পার্বন হোক বা পাড়ার কোনো অনুষ্ঠান। ক্লাবের বাৎসরিক অনুষ্ঠান হোক বা ব্যাবসায়িক ভিত্তিতে ত্রিপল খাটিয়ে সারারাত সিনেমা দেখার জন্য ভীড় জমাতো আবাল বৃদ্ধ বনিতা। প্রত্যন্ত গ্রামের মাঠে পর্দা টাঙিয়ে প্রজেক্টরের সাহায্যে খোলা আকাশের নিচে ব্যাবস্থা করা হতো সিনেমা দেখানোর।এর জনপ্রিয়তা ছিল আকাশছোঁয়া। গ্রামাঞ্চলে এর নাম ছিল “বায়োস্কোপ’।
বাঁশ ও লোহার রড দিয়ে কুড়ি ফুট লম্বা ও আঠারো ফুট চওড়া সাদা কাপড়ের উপর ফুটে উঠতো বিভিন্ন চলচিত্র। চলচিত্র চালানোর দায়িত্ব থাকতো প্রজেক্টরম্যানের উপর।দিনবদলের ফলে নতুন প্রযুক্তির দাপটে হারিয়ে গেছে এই ষোলো মিলি মিটারের প্রজেক্টরে সিনেমা দেখার রেওয়াজ। শ্যামপুরের নবগ্রামের বাসিন্দা এক সময়ের প্রজেক্টর অপারেটর প্রবীর মন্ডল। তিনি বলেন ক্যালকাটা ইনফরমেশন সেন্টারে পরীক্ষা দিয়ে পাশ করার পর কলকাতার একাধিক সিনেমা হলে তিনি কাজ করেছেন।
সেখানে কাজ করতে করতেই ৯০ শতকের গোড়ার দিকে প্রায় তিরিশ হাজার টাকা খরচ করে কিনেছিলেন দুটি ষোলা এম এম প্রোজেক্টর মেশিন এবং আনুষঙ্গিক উপকরণ। তিনি বলেন সেই সময় এই প্রজেক্টর মেশিনের চাহিদা এত বেশি ছিল যে সিনেমা ডিস্ট্রিবিউটরদের নিজস্ব প্রজেক্টরের টান পড়ে যেতো।সেই সময় প্রজেক্টর মেশিনের ভাড়া ছিল দিন প্রতি একশো পঁচিশ টাকা। আর প্রজেক্টরম্যানের মজুরি ছিল তিরিশ টাকা। তারা আমার কাছ থেকে মেশিন ভাড়া নিতেন। সারা পশ্চিমবঙ্গ ঘুরতাম প্রজেক্টর মেশিন ও আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতি নিয়ে।
তিনি আরো বলেন ১৯৯৪-৯৫ সালের পর থেকেই বায়োস্কোপের বাজারে ভাঁটা পড়তে শুরু করে। স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে তিনি বলেন খোলা মাঠে মাথায় ত্রিপল খাটিয়ে শোয়ের আয়োজন হতো। প্রতিটি শোয়ে হাজার হাজার মানুষ ভীড় জমাতো। তার দাবি ১৯৯৫ সালের পর থেকেই মানুষের হাতে এসে যায় টিভি, ভি সি পি ও ভি সি আর। তারপর থেকে আর বাজারে জোয়ার আসেনি। ২০১৩ সালে কলকাতার এক কম্পানির হয়ে শেষ বারের মতো তিনি শো করেছিলেন দক্ষিণ ২৪ পরগনার মহেশ্বরপুরে।
চাহিদা না থাকলেও স্মৃতি হিসেবে সেই দুটি প্রজেক্টর মেশিন ও তার আনুষাঙ্গিক জিনিসপত্র বাড়িতে সযত্নে রেখে দিয়েছিলেন প্রবীর বাবু। কিছুদিন আগে একটি মেশিন নিয়ে গেছে একটি বেসরকারি মিউজিয়াম কর্তৃপক্ষ। এখন কাজের মাঝে সময় পেলেই যন্ত্রটি বের করে পরিস্কার করেন প্রবীর বাবু সাথে চলে স্মৃতি রোমন্থন। কারণ হিসাবে তিনি বলেন এই প্রোজেক্টর আমাকে জীবনে অনেক কিছুই দিয়েছে। তাকে কিভাবে দুরে সরিয়ে রাখবো।
তিনি বলেন প্রোজেক্টর মেশিনের কাজ শেষ হয়ে যাওয়ার পর থেকে একটি স্কুলে পার্টটাইম কাজ করার পাশাপাশি টিউশন পড়িয়ে ও ছোটখাটো ট্যুর অ্যারেঞ্জ করে সংসার চালাই। প্রজেক্টর মেশিনটি মুছতে মুছতে তিনি বলেন মানুষ হয়তো আর কোনদিন খোলা মাঠে বসে বায়োস্কোপ দেখবেনা। কিন্তু আমার জীবনের বহু সুখস্মৃতি জড়িয়ে রয়েছে এই মেশিনের সাথে, তাই জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এই মেশিন নিজের কাছে আগলে রাখবেন বলেও তিনি জানান।