বিশেষ প্রতিবেদন : বসন্তের বিকালে সবে সূর্য ডুবে সন্ধ্যা নেমেছে। গ্রাম বাংলার ঘরে ঘরে বেজে উঠেছে শঙখ। বাংলার মা’য়েরা প্রদীপ হাতে তুলসীতলায় সন্ধ্যা দিতে ব্যস্ত। ধূলিধূসরিত গ্রাম বাংলায় ধ্বনিত হচ্ছে ‘এসো মা লক্ষ্মী বসো ঘরে’, ‘ঘুমঘুম চাঁদ ঝিকিমিকি’, বা ‘মায়াবতী মেঘে এলো তন্দ্রা’, ‘এ শুধু গানের দিন’। এমনই এক মায়াবী বসন্ত সন্ধ্যায় আচমকাই সুরের আকাশে অস্তমিত হলেন বাংলার সঙ্গীত জগতের সর্বকালের অন্যতম স্রষ্টা ‘গীতশ্রী’ সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। বাঙালির আবেগ, নস্টালজিয়া, প্রেম, বিরহ, ভালোবাসার সুরগুলোই মুহুর্তের খবরে স্তব্ধ হয়ে গেল। বিস্তারিত জানতে নীচে পড়ুন…
বাঙালির কানে কানে গুণগুণ করে আর কেউ কোনোদিন গাইবে না ‘এ শুধু গানের দিন, এ লগন গান শোনাবার’। তীর বেঁধা পাখিরাও আজ সুর হারা হল। গানে গানেও ইন্দ্রধনু আঁকা আর হবে না। কোনো প্রজাপতি আর গানে গানে রঙ ছড়াবে না। নব্বই বছরের বর্ণময় জীবনজুড়ে সুরের ছটা। গেয়েছেন অজস্র গান। তাঁর গান হয়ে উঠেছে বাঙালির প্রাণের স্পন্দন। আর এভাবেই বাংলার প্রত্যেকটি ঘরের আপনজন হয়ে উঠেছেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। প্রেম কিমবা বিরহ, সাফল্য কিমবা ব্যর্থতা সমস্ত প্রেক্ষাপটেই বড়ো প্রাসঙ্গিক তাঁর গান। দশকের পর দশক ধরে আপন সৃজনে এভাবেই বাংলার সঙ্গীত জগতকে আলোকিত করেছেন।
সঙ্গীত জগতের পাশাপাশি ওপার বাংলার মুক্তিযুদ্ধেও তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। উদ্বাস্তুদের পাশে দাঁড়াতে অর্থ সংগ্রহে নেমেছিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জেলমুক্তির পর বেঁধেছিলেন গান — ‘বঙ্গবন্ধু তুমি ফিরে এলে’। স্বাধীনতা কিমবা আত্মচেতনায় তিনি বরাবরই দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেছেন। তাইতো জীবনের অন্তিম মুহুর্তে এসেও জাতীয় সম্মান ফিরিয়ে দিতে বিন্দুমাত্র সময় নেননি। শিরদাঁড়া সোজা রেখে এভাবেই দশকের পর দশক জুড়ে কোকিল কন্ঠের সুরের জাদুতে মাতিয়েছেন।
কালের অমোঘে নিয়মে ‘পৃথিবীতে আঁধারের ধূপছায়া নামবেই’। তবু ‘কিছুখন আরও না হয় রহিতে কাছে’, ‘সুরে সুরভীত নাহয় ভরিত বেলা’। বাংলার সঙ্গীত সাধনা, বাংলার ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি আজ মাতৃহীন হল। ‘দেবী সুরেশ্বরী’ একাই ‘চন্দন পালঙ্ক শুয়ে’ সুরালোকের পথে। তিনিই তো গেয়েছিলেন ‘এই পথ যদি শেষ না হয়’, সেই অনন্তলোকের পথেই পাড়ি দিলেন বাংলার ‘গীতশ্রী’।