বিশেষ প্রতিবেদক : হাতেমাত্র মাত্র আর কয়েকটা দিন। তারপরই বাংলার বুকে অনুষ্ঠিত হতে চলেছে এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ ধর্মীয় মেলা গঙ্গাসাগর মেলা। গঙ্গাসাগর মেলার উদ্দেশ্যে ইতিমধ্যেই বহু নাগা সাধু কোলকাতার বাবুঘাট চত্বরে এসে উপস্থিত হয়েছেন। জটাধারী চুল, দেহজুড়ে ছাইভষ্ম মাখা। নগ্ন রূপ। সচরাচর নাগা সাধুদের লোকালয়ে খুব কমই দেখা যায়। সাগর মেলা কিমবা উত্তরপ্রদেশের কুম্ভ মেলাতে এদের দেখা মেলে। কারা নাগা সাধু? কেন-ই বা নগ্নরূপ তাদের? তাদের জীবনটা ঠিক কেমন? — এসব প্রশ্নই ঘুরে বেরায় বহু মানুষের মনে। সেসব প্রশ্নের উত্তর নিয়েই আজকের এই প্রতিবেদন। ‘নাগা’ শব্দের অর্থ — বিশ্বের প্রকৃত সত্য অনুসন্ধানকারী। অনেকেই নাগা সাধুদের হিন্দু সনাতন ধর্মের রক্ষক রূপেও অভিহিত করেন। বিস্তারিত জানতে নীচে পড়ুন…
কথিত আছে, নাগা সাধু ত্রেতা যুগে ভগবান দত্তাত্রেয় শুরু করেছিলেন। তিনি হিন্দু সনাতন ধর্ম রক্ষা করেছিলেন। তাই তাঁকে ‘সন্ন্যাসী যোদ্ধা’ বলা হয়। উল্লেখ্য, আজও নাগা সাধুদের হাতে ত্রিশূল দেখা যায়। অন্যান্য সন্ন্যাসীদের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন নাগা সন্ন্যাসীরা। অত্যন্ত কঠোর অনুশীলন, ত্যাগ, তিতিক্ষা ও কঠিন জীবনযাপনের করলে তবেই নাগা সন্ন্যাসী হওয়া সম্ভব। নাগা সন্ন্যাসী হতে চাওয়া ব্যক্তিরা সংসার জীবনের সঙ্গে সমস্ত বন্ধন ছিন্ন করে আখড়ায় আসেন।
সেখানে ৬ থেকে ১২ বছর অব্ধি কঠোর ব্রহ্মচর্য জীবনের মধ্য দিয়ে তাদের চলতে হয়। আখড়ার গুরু যখন মনে করেন যে তাঁর শিষ্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত তখন গুরু তাকে পরবর্তী শিক্ষা দেওয়ার কাজ শুরু করেন। নাগা সন্ন্যাসী হওয়ার জন্য প্রথমে চুল পুরোপুরি কেটে দিতে হয়। পরে ১০৮ বার গঙ্গা নদীর জলে ডুব দিয়ে স্নান করতে হয়। তারপর পাঁচ জন গুরুর অধীনে শিক্ষা শুরু হয়। এরপর নিজের পিন্ডদান ও তর্পণ করতে হয়। এগুলো করার পরে তিনি আখড়ার সন্ন্যাসী হন।
এই পদ্ধতির পরে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে গুরু মন্ত্র দেওয়া হয় এবং পরে তার পুরো জীবন একই গুরু মন্ত্রের জন্য দিতে হয়। নাগা সন্ন্যাসী হওয়ার পরে সমস্ত ধরণের কাপড় ফেলে দিতে হয়। তবে কেউ চাইলে বাদামি রঙের কাপড় পরতে পারেন। নাগা সাধুরা কাউকে প্রণাম করতে ও অভিবাদন জানাতে পারেন না। তবে তারা কেবল কোনও তপস্বীর সামনে এটি করতে পারেন। নাগা সন্ন্যাসীরা কারও নিন্দা করতে পারেন না। এরা দিনে মাত্র একবার খাবার খেতে পারেন।
নাগা সন্ন্যাসী ভিক্ষা চাইতে পারেন। তবে একদিনে কেবল সাতটি ঘরে ভিক্ষা চাইতে পারেন। এই সাতটি বাড়ি থেকে যদি তারা কিছু না পান তবে তাদের সারাদিন ক্ষুধার্ত অবস্থায় থাকতে হবে। নাগা সন্ন্যাসীরা বিশেষত তাদের তিলকের প্রতি বিশেষ মনোযোগ দেন। সমস্ত নাগা সাধু প্রতিদিন একই ভাবে তিলক পরে থাকেন। চারটি কুম্ভের পর নাগা সন্ন্যাসীদের দীক্ষা দেওয়া হয়। এই সময় তাদের যৌনাঙ্গকে বিশেষ উপায়ে অক্ষম করে দেওয়া হয়। জানা যায়, নাগা সন্ন্যাসীরা সারা জীবন শরীরে তেল ও সাবান লাগাতে পারেন না৷
পাশাপাশি শরীরে ভস্ম মেখে থাকেন। ভস্মে থাকে গোবর, বেলপাতা, কলা সহ বিভিন্ন দ্রব্য। এগুলির সাথে কাঁচা দুধ মিশিয়ে এক মিশ্রণ তৈরি করা হয়। তা গায়ে মেখে থাকেন নাগা সন্ন্যাসীরা। জানা যায়, এই ভস্ম বিষাক্ত পতঙ্গ, সাপের হাত থেকে রক্ষা করে। শুধু যে পুরুষরাই নাগা সাধু হন এমনটা নন। মহিলারাও নাগা সাধু হন। পুরুষদের মতো সমান সম্মান মহিলা নাগাদের দেওয়া হয়। পুরুষদের মতোই মহিলাদেরও চুল ফেলা, নিজের পিন্ডদান, তর্পণ, গঙ্গাস্নান করতে হয়।
পার্থক্য বলতে, পুরুষ নাগারা সম্পূর্ণ বস্ত্রহীন অবস্থায় থাকেন কিন্তু মহিলা নাগারা একটুকরো সেলাইহীন হলুদ কাপড়ে নিজেদের শরীর ঢেকে রাখেন। পুরুষ, মহিলাদের পাশাপাশি বাল নাগা অর্থাৎ বালক নাগাদের দেখা মেলে। জানা যায়, অনেকেই নাগা সন্ন্যাসীদের কাছে মানত করেন। মনস্কামনা পূর্ণ হলে তাঁরা শিশুর জন্মের পর শিশুকে নাগা সন্ন্যাসীদের কাছে দিয়ে দেন। নাগা সন্ন্যাসীদের কাছেই কঠোর শাসনের মধ্য দিয়ে সেই সন্তান বেড়ে ওঠে। ছোটো থেকেই কঠোর প্রশিক্ষণ চলে। অস্ত্রশিক্ষার পাশাপাশি চলে বিভিন্ন পরীক্ষা।
একের পর এক পরীক্ষায় সঠিকভাবে উত্তীর্ণ হলে তবেই মন্ত্র দেওয়া হয়। অনেকেই নাগা সন্ন্যাসীদের হিংস্র মনে করেন। এই ধারণা একেবারেই ভুল ও ভিত্তিহীন। নাগারা আদপে ফৌজি। আক্রান্ত সনাতনী হিন্দুধর্মের রক্ষক। একদা তাঁরা দেশীয় হিন্দু রাজাদের ফৌজ হিসেবে সৈন্যদলে কাজ করতেন। অস্ত্রবিদ্যায় পারদর্শী, কিন্তু কখনোই হিংস্র নন। আজও শাহী স্নানে(পড়ুন কুম্ভে স্নান) আগে স্নান করানো হয় নিজ গোষ্ঠীর ইষ্টদেবকে। তার পরে অস্ত্রগুলি, যেমন ভল্ল, বর্শা, কুঠার প্রভৃতিকে। তারপর জলে ঝাঁপ দেন নাগা সন্ন্যাসীরা।