পৃথ্বীশরাজ কুন্তী : উত্তরে হিমালয় থেকে দক্ষিণে কণ্যাকুমারী, পশ্চিমে থর মরভূমি থেকে, পূর্বে বঙ্গদেশ — সুবৃহৎ ভারতভূমি বড়োই বৈচিত্র্যময়। নদী, পাহাড়, সমুদ্র, মরুভূমি, জঙ্গল কী নেই ভারতের এই পুণ্যভূমে। প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যেও সমৃদ্ধশালী ভারতবর্ষ। তাই ভ্রমণ পিপাসু মন বারেবারে ভারতের এই প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে জানতে, সামনে থেকে চাক্ষুষ করতে ছুটে চলে। অজানাকে জানার, অদেখাকে দেখার তাগিদে সুযোগ পেলেই বেরিয়ে পড়ি। পুজোর সময় ট্রেনের টিকিটের চাহিদা তুঙ্গে থাকে। তাই প্রতিবছরই প্রায় ৪ মাস আগেই টিকিট কেটে রাখতে হয়। এবার জুলাই মাসে টিকিট কাটার সময় ভেবে উঠতে পারছিলাম না কোথায় টিকিট কাটব। আসলে কোভিডের জেরে তখনও বেশিরভাগ জায়গাই বন্ধ ছিল। সাতপাঁচ ভেবে ভেবে অবশেষে গুয়াহাটির টিকিট কেটে ফেললাম। যদিও ভ্রমণের গন্তব্য কোথায় হবে তা তখনও অনিশ্চিত। কখনো মনের কোণে উঁকি দিচ্ছে সূর্যোদয়ের রাজ্য অরুণাচল, আবার কখনও বা মেঘেদের দেশ মেঘালয় কিমবা মণিপুর বা মিজোরাম। এসব ভাবতে ভাবতেই ব্যস্ত জীবনে কেটে গেল দু’দুটো মাস। সেপ্টেম্বরের শেষ দিক। এবার যে গন্তব্য নিশ্চিত করতেই হবে। মুঠোফোন আর রকমারি অ্যাপের সৌজন্যে বাড়িতে বসেই পুরো ট্যুরের গাড়ি, হোটেল করে নিলাম। বিস্তারিত জানতে নীচে পড়ুন…
এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। বিজয়া দশমীর পরের দিনই ব্যাগপত্র নিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম। সাথী আরও কয়েকজন। বিকালে হাওড়া থেকে ট্রেন ধরে পরের দিন সকাল সকাল পৌঁছে গেলাম উত্তর-পূর্ব ভারতের যোগাযোগ ব্যবস্থার অন্যতম স্তম্ভ গুয়াহাটি স্টেশনে। ঝাঁ চকচকে প্ল্যাটফর্ম চত্বর। বেশ সাজানো গোছানো। স্টেশনের এক্সিট পয়েন্টে ভিড়ে ভিড়কান্ড। লাইন দিয়ে ডাবল ভ্যাক্সিনেশন সার্টিফিকেট দেখিয়ে এক্সিট পাস করাতে হচ্ছে, নয়ত ওখানে আরটিপিসিআর করাচ্ছে। আমাদের বেশিরভাগেরই ডাবল ভ্যাক্সিন হয়ে গিয়েছিল। তাই ভ্যাক্সিনেশন সার্টিফিকেটের কপি দেখিয়ে এক্সিট পাস নিয়ে খুব সহজেই আমরা বেরিয়ে পড়লাম। স্টেশন চত্বরের বাইরে অপেক্ষারত গাড়িতে চেপে আমাদের গন্তব্য শিলংয়ের উদ্দেশ্যে পাড়ি দিলাম। গুয়াহাটি শহরটি বেশ সাজানো গোছানো। একাধিক উড়ালপুল ধরে পাহাড়ের গা বেয়ে আমরা ঢুকে গেলাম মেঘালয় রাজ্যে। এখানেই কাটবে আগামী বেশ কয়েকদিন। মেঘালয়ে ঢুকতেও কোভিড ভ্যাক্সিনেশন সার্টিফিকেট ও অনলাইনে জমা করা ট্রাভেল পাস দেখাতে হল। তারপরই মিলল মেঘের রাজ্যে প্রবেশের অনুমতি। পথেই মধ্যাহ্নভোজন সেরে পৌঁছে গেলাম উমিয়াম লেকে।
গুয়াহাটি – শিলং ৪০ নং জাতীয় সড়কের পাশেই সুবিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে অবস্থান করছে নয়নাভিরাম উমিয়াম লেক (স্থানীয় নাম বরাপানী হ্রদ)। উমিয়াম কোনো প্রাকৃতিক হ্রদ নয়। ১৯৬০-এর দশকে বিদ্যুৎ তৈরির লক্ষ্যে উমিয়াম নদীতে বাঁধ দিয়ে পাহাড়ের গায়ে এই সুবিশাল জলাধার তৈরি করা হয়। রাস্তার এক এক জায়গা থেকে উমিয়ামের এক এক রকম ভিউ মেলে। আমরা উমিয়াম ওয়াটার স্পোর্টস কমপ্লেক্সে নামলাম। গাড়ি থেকে নামতেই কিছু বোঝার আগেই ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামল। তখনই মনে হল মেঘালয়ে এসে গেছি। ছাতা খুলে হ্রদের দিকে কিছুটা এগোতেই আবার রোদ। রোদবৃষ্টির খেলা আর উমিয়ামের অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে দু-চোখ ভরে উপভোগ করলাম। চড়ে বসলাম স্পিডবোটে। মিনিট পাঁচেকের জার্নি হলেও পড়ন্ত বিকালে উমিয়ামের বুক থেকে দু’ই পাহাড়ের খাঁজে সূর্যের অস্তমিত হওয়ার মুহুর্তখানা অসাধারণ। পাহাড়ের গা ধরে হ্রদের বেশ কিছুটা অংশে ঘুরল বোট। মন না চাইলেও অপরূপা উমিয়ামকে বিদায় জানিয়ে আমরা এগিয়ে চললাম শিলং শহরের উদ্দেশ্যে।
সন্ধ্যা নামার আগেই পৌঁছে গেলাম শিলং শহরে আমাদের থাকার জায়গা এল্ডোরাডো গেস্ট হাউসে। অত্যন্ত সাজানো গোছানো কাঠের তৈরি কয়েকটা বাড়ি। সেখানেই আমাদের রাত্রিবাস। একদিকে দীর্ঘ প্রায় দেড় দিনের জার্নি, অন্যদিকে পরের দিন সকাল সকাল বেরোতে হবে। তাই বেশি দেরি না করে আমরা সেদিন তাড়াতাড়ি ঘুমের দেশে পাড়ি দিলাম। পরেরদিন সকাল থেকে শিলং শহরের বিভিন্ন দর্শণীয় স্থান একে একে ঘুরে দেখলাম। প্রথমেই চলে গেলাম এলিফ্যান্ট ফলসে। তিনটি ধাপে পাহাড়ের উপর থেকে নেমে আসছে ঝর্ণা। পূর্বে খাসি উপজাতির মানুষজন এটিকে ‘ত্রি-স্তরীয় ঝর্ণা’ নামে আখ্যায়িত করলেও পরবর্তী সময়ে ব্রিটিশরা এর নাম দেয় ‘এলিফ্যান্ট ফলস’। জানা যায়, ঝর্ণার বাঁ দিকে হাতির ন্যায় একটি পাথর থাকায় ব্রিটিশর এহেন নামকরণ করেছিলেন। যদিও ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে সেই পাথর ভূমিকম্পের ফলে নষ্ট হয়ে যায়। এলিফ্যান্ট ফলসের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য চাক্ষুষ করে আমরা পৌঁছে গেলাম উত্তর-পূর্ব ভারতের সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র ডন বস্কো মিউজিয়ামে।
এই মিউজিয়ামে খুব পুঙখানুপুঙখভাবে উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলির সংস্কৃতি, ইতিহাস, ভূগোল, মানুষের জীবন, জীবিকা, আচার, অনুষ্ঠান, জীববৈচিত্র্যতাকে তুলে ধরা হয়েছে। সাততল বিশিষ্ট মিউজিয়ামটি ঘুরে দেখলে উত্তর-পূর্ব ভারতের উপর সম্যক ধারণা তৈরি হবে। মিউজিয়ামটি সরকার দ্বারা পরিচালিত নয়। ‘Don Bosco Centre for Indigenous Cultures’ নামক একটি প্রতিষ্ঠান এটি পরিচালনা করে। ২০১০ সালে মিউজিয়ামটির উদ্বোধন করেন সোনিয়া গাঁন্ধী। এটি ঘুরে দেখতে বেশ কয়েক ঘন্টা কেটে যাবে। আমাদেরও প্রায় আড়াই ঘন্টা লাগল। সবশেষে মিউজিয়ামের টপ ফ্লোরের স্কাই ওয়াক থেকে একঝলকে শিলং শহরকে দেখে আমরা পাড়ি দিলাম আমাদের পরবর্তী গন্তব্য হাইডেরি পার্কে। কোভিডের কারণে শিলং পিক বন্ধ থাকায় শিলং পিক থেকে শিলং শহরের মায়াবী রূপ দর্শন করা থেকে আমর এবারের মতো বঞ্চিতই থেকে গেলাম। হাইডেরি পার্ক থেকে পৌঁছে গেলাম শিলং শহরের অদূরে রবীন্দ্রনাথের স্মৃতি বিজড়িত বাড়ি ‘জিৎভূমি’তে। ১৯২৩ সালের এপ্রিল, মে ও জুন মাসে এই বাড়িতেই কাটিয়েছিলেন বিশ্বকবি।
এখানে বসেই তিনি লিখেছিলেন ‘রক্তকরবী’ নাটক, ‘শিলংয়ের চিঠি’ কবিতা। কবির স্মৃতিবিজড়িত বাড়ি ঘুরে দেখলাম। সন্ধ্যায় শিলং পুলিশ বাজারটা একটু ঘুরে দেখলাম। যদিও দার্জিলিং, গ্যাংটকের ম্যালের মতো ওতো জমজমাট নয়। তবে পুলিশ বাজারে বহু দূরদূরান্ত থেকে মানুষ কেনাকাটা করতে আসেন বলে মনে হল। যাইহোক সেদিনের মতো হোটেলে ফিরে পড়লাম। পরের দিন সকাল সকাল বেরিয়ে পড়লাম। মেঘের মধ্য দিয়েই আপার ডিপার করতে করতে এগিয়ে চলল আমাদের গাড়ি। কখনো মেঘ সরে একটু ঝলমলে রোদে ভেসে উঠছে সামনের পাহাড় আবার বা মুহুর্তের মধ্যেই ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামছে। এভাবেই একে একে দেখলাম নহকালিকাই ফলস(ভারতের উচ্চতম ঝর্ণা, উচ্চতা ১১১৫ ফুট), ওহাকাবা ফলস, ডেনথালেন ওয়াটার ফলস, সেভেন সিস্টার্স ফলস। সত্যি বলতে আগেও ঝর্ণা দেখেছি বিভিন্ন পার্বত্য ও মালভূমি অঞ্চলে। কিন্তু ঝর্ণার সৌন্দর্য যে এতো মনোমুগ্ধকর হয় তা সত্যিই ভাবনাতীত ছিল। এ বলে আমায় দেখ তো ও বলে আমায় দেখ। প্রত্যেকটা ঝর্ণা নিজস্ব সৌন্দর্যে উদ্ভাসিত। সুউচ্চ পাহাড় থেকে গভীর গিরিখাতে পড়ছে নহকালিকাই ফলস, আবার বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে ডেনথালেন ফলসের অবস্থান। এরপর আমরা চলে গেলাম আরওয়া গুহায়। প্রাকৃতিক গুহা। গুহার ভিতর পাথরের গা বেয়ে কোথাও জল পড়ছে আবার কোথাও বা জল জমে রয়েছে। যদিও গুহার মধ্যে রাস্তা নির্মাণ ও পর্যটকদের আধিক্যের জেরে গুহার প্রাকৃতিক স্বাদটা কিছুটা হলেও বিঘ্নিত হয়েছে বলে মনে হল।
যাইহোক এরপর আমরা পৌঁছে গেলাম মাসুমাই কেভে। পাশাপাশি, দু’টি গুহা রয়েছে। প্রথমটিতেই মূলত পর্যটকরা যায়। দ্বিতীয় গুহায় খুব একটা পর্যটকরা যায়না। প্রথম গুহা থেকে বেরিয়ে টিকিট কেটে দ্বিতীয় গুহায় ঢুকলাম। গা ছমছমে ভাব। আলো লাগানো থাকলেও বেশিরভাগই খারাপ হয়ে বন্ধ। গুহার ভিতরের চড়াই-উতরাই রাস্তা। কোথাও বাঁশের সরু জীর্ণ সাঁকো করা, আবার কোথাও সাঁকো ভেঙেই গেছে। রীতিমতো হামাগুড়ি দিতে দিতে অতি সন্তর্পণে এগিয়ে চললাম। এভাবেই ভয়ঙ্কর সুন্দর অভিজ্ঞতার সাক্ষী থাকলাম। এদিকে বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টিস্নাত পথ ধরে গাড়ি চলল চেরাপুঞ্জির(অপর নাম সোহরা) স্যালম গেস্ট হাউসের পথে। সন্ধ্যায় পৌঁছে গেলাম চেরাপুঞ্জির গেস্ট হাউসে। নিস্তব্ধ পাহাড়ি এলাকা। বেশ হাওয়া চলছে। সাথে বৃষ্টি। এখানেই আগামী তিনটে রাত কাটবে। সারাদিন অনেকটা ঘুরে শরীর বেশ ক্লান্ত। তাই কোনোরকমে নৈশভোজ সেরে সেদিনের মতো ঘুমিয়ে পড়লাম। পরেরদিন সকাল সকাল প্রাতরাশ সেরে বেরিয়ে পড়লাম ডাবল ডেকার রুটব্রিজ ট্রেকিংয়ের উদ্দেশ্যে।
নির্দিষ্ট দূরত্বে গিয়ে গাড়ি আমাদের নামিয়ে দিল। তারপর গাইড নিয়ে হাঁটা শুরু। লাঠি হাতে সিঁড়ি ভেঙে নেমে চলা। দু’ধারে ঘন জঙ্গল। জঙ্গলের নানা পতঙ্কের শব্দ শিহরণ জাগাচ্ছে। জঙ্গল পেরিয়ে কোথাও বা সামান্য ছোট্ট একটা ভিউ পয়েন্ট। সামনে তাকালেই দেখা মিলছে সবুজ বনানী আবৃত পাহাড়ের। আর তার গা বেয়ে নেমে আসছে ঝর্ণার জলরাশি। প্রায় ঘন্টাদেড়েক এভাবেই হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছালাম Nongthymmai নামক একটি গ্রামে। দশ-বারোটি ছোটো বাড়ি। প্রত্যেকটা বাড়িতেই রঙবেরঙের ফুলের গাছ। রয়েছে লেবুর গাছ। গ্রামটিতে রয়েছে একটি চার্চ। মূলত পর্যটনের উপর নির্ভর করেই পেট চলে এই প্রান্তিক গ্রামের বাসিন্দাদের। বাড়ির ছেলেরা গাইডের কাজ করেন, মহিলারা ট্রেক রুটের কোথাও না কোথাও দোকান চালান। তবে কোভিডের জেরে দীর্ঘদিন মেঘালয়ের পর্যটন শিল্প বন্ধ থাকায় গ্রামের মানুষজন যে চরম সমস্যায় পড়েছিলেন তা আমাদের গাইডের থেকে জানতে পারলাম। গ্রামে একটু জিরিয়ে নিয়ে সামনে এগোনা গেল। পথের ধারে থাকা বোর্ড বলছে এখনো বেশ কিছুটা পথ পাড়ি দিতে হবে। এরপর একটি দড়ির ব্রিজ ক্রস করতে হল। লোহার দড়ির দিয়ে তৈরি সরু ব্রিজ। নীচ দিয়ে বয়ে চলেছে খরস্রোতা নদী। খুব সন্তর্পণে তা পার হওয়া গেল। আবারও একটা ঝুলন্ত সেতু অতিক্রম করে এবার পাহাড়ের গা বেয়ে উঠে যেতে হল। বেশ কিছুটা হাঁটার পরই আমরা আমাদের অভীষ্ট গন্তব্যে পৌঁছে গেলাম। বিশ্বের বিস্ময় উমসিয়াং গ্রামের দ্য ডাবল ডেকার লিভিং রুট ব্রিজ — অসাধারণ, অনবদ্য, অভাবনীয়। দীর্ঘক্ষণের ট্রেক সার্থক। কয়েক ঘন্টা হাঁটার ক্লান্তি মুহুর্তেই দূর হয়ে গেল। রুটব্রিজে উঠলাম, এবং মুঠোফোনে সেসব মুহুর্তকে বন্দী করলাম। জানা যায়, এই অঞ্চলে কয়েকশো বছর ধরে নৃ-জাতি গোষ্ঠীর মানুষ বসবাস করেন। এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়ে যেতে তাদের ছোটো ছোটো জলধারা অতিক্রম করতে হয়। তা-ই নিজেরাই এক গাছের সাথে আর এক গাছের শিকড়কে জুড়ে এভাবেই প্রাকৃতিক ব্রিজ বানিয়ে ফেলেছেন স্থানীয়রা।
তবে এই ডাবল ডেকার রুট ব্রিজ কতদিনের প্রাচীন তার প্রামাণ্য তথ্য নেই। রাবার গাছের শিকড় দিয়েই এটি তৈরি। ১৮৪৪ সালে ‘এশিয়া সোসাইটি অফ বেঙ্গল’ নামের এক জার্নালে ব্রিটিশ লেফট্যানেন্ট এইচ ইউল প্রথম এই ব্রিজটির কথা উল্লেখ করেন। ডাবল ডেকার রুট ব্রিজ থেকে আরও বেশ খানিকটা পথ ট্রেক করলে দেখা মিলবে রেনবো ফলসের। কিন্তু সময়াভাবে তা আর হলনা। এবার উপরের দিকে ওঠার পালা। ফেরার পথে দেখতে হবে সিঙ্গেল রুট ব্রিজ। এটিও বেশ আকর্ষণীয়। দু-চোখ ভরে প্রকৃতির অপরূপ রূপকে চাক্ষুষ করতে করতে সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠে চললাম। দীর্ঘপ্রায় সাড়ে সাত ঘন্টার একটা ট্রেক শেষ হল। ওঠানামায় প্রায় তেরো হাজার সিঁড়ি। সন্ধ্যায় হোটেলে ফিরে লম্বা বিশ্রাম। পরের দিন সকাল সকাল গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম ভারত-বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী তামাবিল সীমান্তের উদ্দেশ্যে। সোহরা থেকে দূরত্ব প্রায় ৮৫ কিমি। তামাবিল সীমান্তে ভারত ও বাংলাদেশের লরি বিভিন্ন সামগ্রী নিয়ে যাচ্ছে, নিয়ে আসছে। কথা বলে জানতে পারলাম, ভারত থেকে এই স্থলবন্দরের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ পাথর ও কয়লা ওদেশে যায়। বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন ইলেকট্রনিকস জিনিস এদেশে আসে। উভয় দেশেরই বেশ কিছু পর্যটক এসেছেন সীমান্ত দেখাতে। প্রত্যেকেই ছবি তুলতে ব্যস্ত। তবে দু’ই দেশের নিরাপত্তা বাহিনীর জওয়ানরা জিরো পয়েন্টের উপর সবসময় কড়া নজর রাখছেন। লরি, ডাম্পারের আধিক্যের জন্য এলাকাটি অত্যন্ত ধুলোপ্রবণ। ওখান থেকে কিছুটা দূরেই অবস্থান করছে ডাওকি। চলে এলাম ডাওকিতে। অনেকেই ডাওকিকে নদী বলেন। আসলে ডাওকি কোনো নদী নয়, আদপে ডাওকি একটি গ্রাম। একদম বাংলাদেশ সীমান্ত লাগোয়া। ডাওকিতে রয়েছে উমগট নদী৷ দু’ই পাহাড়ের মাঝ দিয়ে বয়ে গিয়েছে উমগট। দু’ই পাহাড়ের সংযোগকারী অনুপম সুন্দর একটি ব্রিজ। এটি এশিয়ার স্বচ্ছ নদী হিসাবে পরিচিত। উমগটের জল এতোটাই স্বচ্ছ যে নদীতে থাকা পাথর ও মাছ দেখা যায়। উমগটের বুকে নৌকাবিহারের ব্যবস্থা রয়েছে।
পাশেই রয়েছে বাংলাদেশের জাফলং পর্যটনকেন্দ্র। কাঁটাতারের বেরা না থাকলেও রয়েছে পাথর যা দু দেশের সীমান্তকে চিহ্নিত করছে। সাথে দু-দেশের নিরাপত্তা বাহিনীর জওয়ানরাও পর্যটকদের গতিবিধির উপর কড়া নজর রাখছেন। উমগট নদীতে নৌকাবিহার করলাম। নদীতে স্থানীয়রা ছিপ ফেলছেন। পাহাড়ের গা বেয়ে ছোটো ছোটো জলের ফ্লো নেমে আসছে নদীতে। দূরে দু’ই পাহাড়ের সংযোগকারী ব্রিজ, অন্যদিকে বাংলাদেশের জাফলং পর্যটনকেন্দ্রে ওপার বাংলার মানুষদের ভিড়। সবনিয়ে একটা মনোমুগ্ধকর অভিজ্ঞতা। ডাওকিকে বিদায় জানিয়ে এবার আমাদের গন্তব্য মাওলিনং। কাঁটাতারের বেড়ার ধার ধরে পাহাড়ের বুক চিরে চলে গিয়েছে রাস্তা। পথের দু’ধারে সুপারি ও কলা বাগানের সারি। সেই পথ ধরে পৌঁছে গেলাম মাওলিনংয়ে। এটিকে এশিয়ার ‘পরিচ্ছন্নতম গ্রাম’ হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়। গ্রামজুড়ে সবুজে ভরা গাছগাছালি, রকমারি ফুলের বাহার। দেখা মিলছে রংবেরঙের প্রজাপতির। বাড়িগুলো সুন্দর করে সাজানো। সুন্দর রুচির ছাপ সর্বত্র। ডাস্টবিনগুলোও সুন্দর। পরিবেশবান্ধব সামগ্রী দিয়েই তৈরি করা হয়েছে ডাস্টবিন। গ্রামের মানুষের পোশাক-পরিচ্ছদ, বাড়িঘর, রাস্তাঘাট সব কিছু একদম ঝাঁ চকচকে। গ্রামে রয়েছে বড়ো চার্চ, ট্রি হাউস। রয়েছে সবুজ ঘাসের ফুটবল মাঠ। বেশ সাজানো গোছানো গ্রাম। কিন্তু গ্রামে নির্মিত পিচের সড়ক কোথাও যেন কৃত্রিমতার ছাপ রাখছে বলে মনে হল। মাওলিনংয়ের পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে খরস্রোতা পাহাড়ি নদী থাইলাং।
এই নদীর প্রকৃতি ও মানুষের যৌথ প্রয়াসে এক বিস্ময়কর সেতু তৈরি হয়েছে যাকে অনেকে লিভিং রুট ব্রিজ হিসাবে আখ্যায়িত করে থাকেন। মাওলিনং দেখে চেরাপুঞ্জির হোটেলে ফিরে পড়লাম। পরেরদিন সকালে পৌঁছে গেলাম মাওফলাং স্যাকরেড ফরেস্টে। জঙ্গলে ঢোকার প্রবেশপথেই রয়েছে সবুজ ঘাসে মোড়া সুন্দর একটি উপত্যকা। চারিদিক জুড়ে এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা। মেঘমুক্ত সুনীল আকাশ। মনে হবে ইউরোপের কোনো দেশের ভ্যালিতে এসে উপস্থিত হয়েছি। ভিতরে গভীর জঙ্গল। এমনকি এই জঙ্গলে ট্রেক রুটও রয়েছে। হাতে অল্প সময় থাকায় গাইড নিয়ে জঙ্গলের ভিতরে ঢুকে একটু ঘুরে দেখলাম। এখানকার উপজাতির সংস্কৃতি ও রীতিনীতিতে জঙ্গল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। জঙ্গলকে অত্যন্ত পবিত্র বলে মনে করা হয়। তাই এই জঙ্গলে শিকার তো দূরের কথা, জঙ্গলের কোনো গাছের একটা পাতাও কেউ জঙ্গলের বাইরে আনেন না। জঙ্গলের ভিতরে বেশ কয়েকটি ছোটো বড়ো পাথর রয়েছে। এগুলিকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন কাহিনী প্রচলিত রয়েছে। স্যাকরেড ফরেস্ট দেখে আমাদের ফেরার পালা। শিলং হয়ে কামাক্ষ্যা আসার কথা থাকলেও আমাদের হাতে কিছুটা সময় থাকায় আসামের পবিতোরা ন্যাশনাল পার্কে জিপ সাফারি করলাম। খুব ঘন জঙ্গল না হলেও ভালো লাগল। দেখা মিলল বেশ কয়েকটি একশৃঙ্গ বিশিষ্ট গন্ডারের। এরপর ব্রহ্মপুত্রের বুকে লঞ্চে চড়ে সূর্যাস্ত দেখার অভিজ্ঞতার সাক্ষী থাকলাম। বিস্তীর্ণ নদী। দূরে দু’ই পাহাড়ের খাঁজে অস্তমিত হচ্ছে বরুণদেব — মাঝ নদীতে দাঁড়িয়ে এ দৃশ্য দেখার অনুভূতিই অনন্য।
একটু দেরী হওয়ায় মা কাম্যাক্ষার দর্শন না পেলেও মা’য়ের আশীর্বাদকে সাথে নিয়ে এবারের মতো নর্থ-ইস্টকে সাদরে বিদায় জানিয়ে পা বাড়ালাম বঙ্গভূমির পথে। মেঘালয় মানে পাহাড়ের নান্দনিকতা এবং সবুজে ঘেরা বৃক্ষরাজির এক অপরূপ নন্দনকানন, মেঘালয় মানে কখনো মেঘ কখনো বৃষ্টি, মেঘালয় মানে পাহাড়-জঙ্গল-নদী-ঝর্ণার সমাহার, মেঘালয় মানে পাহাড়ি উপজাতির ঐতিহ্য-কৃষ্টি-সংস্কৃতির মেলবন্ধন। সর্বোপরি, মেঘালয় মানে একটা মোহ। যে মোহের টানে কবিগুরুর ন্যায় বরেণ্য বাঙালি বারেবারে মেঘালয়ে গেছেন, যে মোহের টানে বারেবারে শিলংয়ে ছুটে এসেছেন ব্রিটিশরা, সেই মোহের টানে আজও মেঘালয়ের বুকে ছুটে চলেছেন পাহাড় ও প্রকৃতিপ্রেমী, ভ্রমণপিয়াসী অজস্র মানুষজন। আসলে সে যে মেঘেদের দেশ মেঘালয়।